ঈদে দেশে আপনারা যখন সেমাই, পোলাও, গোস্ত খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক তখন অধিকাংশ প্রবাসী বাংলা রেস্টুরেন্টে বসে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর চেষ্টা করছেন। ঈদে আপনি প্রিয়জনকে পাশে না পেয়ে যতটুকু আফসোস করছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি আফসোস করছে প্রবাসে থাকা আপনার প্রিয়জনটি। আপনারা দিচ্ছেন তাদের টাকায় কোরবানি কিন্তু এই প্রবাসীরা দিচ্ছেন আপনাদের জন্য কোরবানি।
একজন প্রবাসী ইমিগ্রেশন গেট একবার অতিক্রম করলে যে জায়গাটিকে তিনি চিরকালের জন্য বাড়ি বলেছিলেন, সেটি আর তার বাড়ি থাকে না। চাইলেই ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ পায় না। যে দেশটি চিরকাল আপন বাড়ি ছিল, সেই দেশটি এখন এমন একটি জায়গা যেখানে তিনি বেড়াতে আসবেন মাত্র। হ্যাঁ সেটিই তখন থেকে তার কেবল জ্বলন্ত স্মৃতি। তারপরে প্লেনে এবং ধীরে ধীরে লাল সবুজের দেশকে মেঘের মধ্যে মানচিত্রটি বিলুপ্ত হতে থাকে। তখন সেই একমাত্র বুঝতে পারে, সে যা ভালোবাসতো তা কেবল আকাশের নিচে বিবর্ণ হয়ে গেছে এবং সেই জীবনটিই তিনি আবার নতুন করে শুরু করার জন্য যুদ্ধে যাচ্ছেন। হ্যাঁ এটিই প্রবাসী জীবনের বাস্তবতা।
মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদ। তাই সেটা ঈদুল ফিতর হোক আর ঈদুল আজহা হোক, প্রতিবছর খুশির বার্তা নিয়ে আসে এ দুই ঈদ। পরিবারের সচ্ছলতা, নিজের ভবিষ্যৎ এবং দেশের কল্যাণের জন্য দীর্ঘদিন বাইরে ঈদ করা প্রবাসীদের কষ্ট যেন হু হু করে বেড়ে উঠে।
ঈদ আসলেই প্রস্তুতির কমতি থাকে না প্রবাসী নামক হতভাগাদের। মানচিত্রে যেন তাদের দুইটা সংসার। একটা দেশে আর একটা প্রবাসে। সে হিসেবে ঈদুল ফিতর শেষ হতেই তারা প্রস্তুতি নেয় ঈদুল আজহার জন্য।
মালয়েশিয়াতে দেখেছি ঈদুল আজহার আগেই প্রবাসীরা বাড়তি কাজ খুঁজতে থাকে। কোরবানি ঈদ ও কেনাকাটার জন্য টাকাটা এবার একটু বেশি দেওয়া লাগবে। এছাড়া গতবারের চেয়ে আব্বা এবার গরু একটু বড় কিনবে। তাছাড়া ছোট ভাই-বোনদের আদর আবদারও আছে। তাই ছুটির দিনেও যেন ছুটি থাকে না তাদের। শুরু হয় ওভার ডিউটি। সময় এদের কখন যায় তা ঠিক পায় না। অধিকাংশ প্রবাসীকে দেখেছি ঈদের আগের রাতে ডিউটি করে এসে বিনা সেভ, চুল না কেটে ও পুরাতন কাপড়ে ঈদের নামাজ পড়তে। আবার অনেকেরই অনেক সময় ঈদের নামাজই ধরতে পারে না।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাওয়ার জন্য সিরিয়াল ধরতে হয়। সেটাও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। অনেক সময় খাবার সময় হয় না। তবুও তাদের কষ্ট করে যেতে হয় শুধুমাত্র পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে।
পাঁচ বছর ধরে বিদেশ এসেছে প্রবাসী। কিছুদিন পরে যাবে। দেশে গিয়ে বিয়ে-শাদী করবে। এমন সময় বাড়ি থেকে খবর এল তার বাড়ির পাশের জমি বিক্রি হবে। এমন সস্তা জমি আর পাওয়া যাবে না। এই কথা শুনে প্রবাসী ভাই বাড়িতে যাওয়ার সুখ ভুলে বুকভরা কষ্ট নিয়ে তার জমানো টাকাগুলো পিতার হাতে তুলে দেয় তার স্বপ্ন পূরণের জন্য। তার আশাগুলোকে তখন কোরবানি দিতে হয় নিমিষেই।
মালয়েশিয়া মুসলিম দেশ হলেও এখানে বেশিরভাগ মালিক চাইনিজ। স্থানীয় নাগরিকদের সঙ্গে প্রবাসীদের ভ্রাতৃত্ববোধ, সৌহার্দ্য প্রকাশ প্রায় শূন্যের কোঠায়। মুসলিম হলেও তারা প্রবাসীদের থেকে নিজেদের আলাদা ও শ্রেষ্ঠ ভাবতে পছন্দ করে। তাদের সঙ্গে প্রবাসীদের সামাজিক সম্পর্ক ঈদের দিনগুলোতেও দেখা যায় না।
নামাজের পর প্রবাসীরা নিজেদের মধ্যে সামান্য মিষ্টি বা ঝাল কিছু তৈরি করে। কেউ বা ঈদের সেমাইটা বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিনে খায়। কেউ বা দেশি রেস্টুরেন্টে থেকে ২/৩ রিঙ্গিতের রান্না করা মাংস কিনে গত রাতের পানি দেওয়া ভাতে শুধু লবণ মিশিয়ে খায়। তারপর দেশে ফোন করে কথা বলেন প্রিয়জনের সাথে। কেউ বা নিভৃতে বসে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলেন। কেউ বা ডুকরে কেঁদে উঠেন। ফলে পাশের রুমের প্রবাসীকেও অজানা কষ্টে দেখা যায় কাঁদতে।
কি ভীষণ কষ্টের একটি দিন। কে বলবে আজ ঈদ! এই দিনে দেশে কাটানো ঈদগুলো তখন এক একটা স্বর্ণালী মুহূর্ত হয়ে চোখের সামনে ভাসে। এত কিছুর পরেও প্রিয়জনের মুখে হাসি ফুটাতে পারলেই যেন খুশি প্রবাসীরা। প্রিয়জনদের মুখের একটু হাসিতেই ভুলে যায় সব কষ্ট।
কোরবানির চিত্র বলছে, এখানে আলাদাভাবে গরুর হাট বসে না। দেশের মতো কোরবানি দিতে দেখিনি মালয়েশিয়ায়। মালয়েশিয়ানরা পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সরকারিভাবে প্রত্যেক মহল্লার মসজিদে কোরবানি দিয়ে থাকে। তারা মসজিদে তাদের ভাগের টাকা দিয়ে আসেন। সেই অনুযায়ী মসজিদে গরু কিনে কোরবানি করা হয়। যিনি টাকা দেন তিনি সাধারণত তার ভাগের জন্য কোনো মাংস দাবি করেন না। তবে কেউ কেউ দুই এক কেজি বাসায় খাবার জন্য আনেন। কোরবানির মাংস বেশির ভাগই গরিব লোকদের মধ্যে ও এতিমখানায় বিলিয়ে দেওয়া হয়।
এর মধ্যে কমিউনিটি লিডার, শিক্ষা ও সামাজিক সংগঠনদের মধ্যে দেখা যায় কিছুটা ঈদের আমেজ। ঈদ উপলক্ষে তারা ঈদ পুনর্মিলন, ঘুরতে যাওয়া ও ঈদ ভোজনের আয়োজন করে। হয় একে অপরের মধ্যে কুশলাদি বিনিময়। কূটনৈতিক পর্যায়ে চলে খুশি ও আত্মত্যাগের বাতায়নে গিফট সামগ্রী আদান প্রদান।