“আর্জেনটিনা“৷ লাতিন আমেরিকার এই দেশটির নাম শুনলেই প্রথমে মাথায় চলে আসে ফুটবল এর কথা। কেননা ফুটবল এর কারনেই আর্জেনটিনা দেশটি প্রায় সারা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের কাছেই পরিচিত। আর আর্জেনটিনার ফুটবল মানেই তো বিশ্বসেরা খেলোয়াড় ম্যারাদনা, মেসি। আর আজকে আপনাদের জানাবো আর্জেনটিনার ফুটবল ইতিহাস ও লিওনেল মেসির আর্জেনটিনার জাতীয় দলে ফুটবল ক্যারিয়ার সম্পর্কে।
আর্জেন্টিনায় ফুটবল খেলা শুরু হয় ১৮৬৭ সালের দিকে। তবে ১৯০১ সালে আর্জেন্টিনার প্রথম জাতীয় ফুটবল দল গঠিত হয়।তাদের প্রথম ম্যাচ ছিল উরুগুয়ের বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচ দিয়ে। তারা ঐ খেলায় প্রথম মুখোমুখি হয়। আর সেই খেলাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৬ মে ১৯০১ সাল। যেখানে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলজয় লাভ করে ৩–২ ব্যবধানে। কোপা লিপতন ছিল আর্জেন্টিনার প্রথম অফিসিয়াল শিরোপা।
উরুগুয়েকে ২–০ ব্যবধানে হারিয়ে ১৯০৬ সালের দিকে এই শিরোপা জেতে তারা।ঠিক একই বছর আর্জেন্টিনা নিউটন কাপেও অংশগ্রহন করেছিল। এবং উরুগুয়েকে ২–১ ব্যবধানে হারিয়েই শিরোপা জিতেছিল তারা । ১৯০৭ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত টানা আরও চারবার এই শিরোপা জেতে আর্জেনটিনা। তাছাড়া তারা ১৯০৬ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত চারবার লিপতন কাপ জিতে।
কনমেবল পরিচালিত দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশীপে (বর্তমান: কোপা আমেরিকা) প্রথম অংশগ্রহন করে আর্জেন্টিনা। তবে এই প্রতিযোগিতায় শিরোপা জেতে উরুগুয়ে।
১৯২১ সালের দিকের প্রতিযোগিতায় তারা উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে এবং ব্রাজিলের বিপক্ষে সবকয়টি ম্যাচেই জয় লাভ করে।
উরুগুয়ের বিপক্ষে ১৯২৪ সালের ২ অক্টোবর একটি প্রীতি খেলায় অংশগ্রহন করে আর্জেন্টিনা। খেলার ১৬তম মিনিটে আর্জেন্টাইন উইঙ্গার সিজারিও ওঞ্জারি কর্ণার কিক থেকে একটি গোল করেন। তিনি কর্ণার কিক নেন। আর কোন খেলোয়াড় বল স্পর্শ না করলেও তা উরুগুয়ের গোলপোস্টের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। আর এই গোলটির নাম দেওয়া হয় ‘‘গোল অলিম্পিকো’’ বা ‘‘অলিম্পিক গোল’’।
আর্জেন্টিনা ১৯২৭ সালের দিকে তাদের তৃতীয় দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশীপ শিরোপা জেতে। আর এই প্রতিযোগিতার তিন ম্যাচের মধ্যে সবকয়টিতেই জয় লাভ করে তারা। আর্জেন্টিনা সর্বপ্রথম ১৯২৮ আমস্টারডাম অলিম্পিকে অংশগ্রহন করে। আর সেখানেও সেই উরুগুয়ের বিপক্ষে ফাইনালে ২–১ ব্যবধানে হেরে রৌপ্যপদক জিতেছিল তারা। আর্জেনটিনা ১৯২৯ সালে টানা দ্বিতীয়বারের মত দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশীপ জেতে। আর এই প্রতিযোগিতায়ও আর্জেন্টিনা সবকয়টি ম্যাচেই জয় লাভ করেছিল। ফিফা প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজন করে ১৯৩০ সালের দিকে। আর এই আন্তঃ প্রতিযোগিতায় আজেন্টিনাসহ মোট ১৩টি দেশ অংশগ্রহন করে। তবে প্রতিযোগিতায় আর্জেনটিনা সবকয়টি খেলায় জয় লাভ করে ফাইনালে পৌছালেও, তারা উরুগুয়ের বিপক্ষে ৪–২ ব্যবধানে হেরে গিয়ে শিরোপা হাতছাড়া করে। আর এই প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ আট গোল করে, সর্বোচ্চ গোলদাতা হন আর্জেন্টিনার গুইলেরমো স্তাবিল।১৯৩৪ বিশ্বকাপে অংশগ্রহন করলেও, প্রথম পর্বে সুইডেনের বিপক্ষে ৩–২ ব্যবধানে পরাজিত হয়ে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা।
আর্জেনটিনার ফুটবল বললে বর্তমানে যার নাম আসে ,তিনি হলেন লিওনেল মেসি।
লিওনেল আন্দ্রেস “লিও” মেসি হলেন একজন আর্জেন্টাইন পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়। যিনি আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে একজন আক্রমণভাগের খেলোয়াড় হিসেবে খেলেন। তিনি ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন আর্জেনটিনায় জন্মগ্রহণ করেন।
বর্তমানে তিনি আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মেসি প্রায়শই বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হিসাবে বিবেচিত হয়। তিনি এখন পর্যন্ত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন হিসাবে বিবেচিত।
লিওনেল মেসি এক টানা চারবারসহ মোট সাতবার এর মত ব্যালন ডি’অর জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। যা হলো ফুটবলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তার পাশাপাশি তিনি সর্বোচ্চ ছয়বার এর মত ইউরোপীয় সোনালী জুতো জয়েরও কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। তবে তাঁর পেশাদার ফুটবল জীবনের পুরোটাই কেটেছে ক্লাব বার্সেলোনায়। সেখানে তিনি ১০টি লা লিগা, মোট ৪টি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং ৬টি কোপা দেল রেসহ মোট ৩৩টি শিরোপা জয় করেছেন, যেটি বার্সেলোনার ইতিহাসে কোন খেলোয়াড়ের পক্ষে সর্বোচ্চ অর্জন। তাছাড়া একজন অসাধারণ গোলদাতা হিসেবে মেসির দখলে রয়েছে লা লিগায় সর্বোচ্চ সংখ্যক গোল। লা লিগা ও ইউরোপের যেকোনো লিগে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোল । তিনি জাতীয় দল এবং ক্লাবের হয়ে ৭০০ এর বেশি পেশাদার গোল করেছেন।
মধ্য আর্জেন্টিনায় জন্ম নেওয়া এবং বেড়ে ওঠা লিওনেল মেসি ছোট বেলায় গ্রোথ হরমোন সংক্রান্ত এক জটিল রোগে আক্রান্ত হন। তখনকার সময় আর্জেন্টিনার কোন ক্লাবের পক্ষে তাঁর চিকিৎসা খরচ বহন করা কোন ভাবেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু সে সময় বার্সেলোনা তাঁর চিকিৎসার খরচ বহনের দায়িত্ব নেন। এতে ১৩ বছর বয়সে তিনি তাদের সাথে ক্লাবের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন এবং তিনি স্পেনে পাড়ি জমান। বার্সেলোনার যুব প্রকল্পে তিনি নিজের প্রতিভার প্রমাণ দেখাতে শুরু করেন ও ২০০৪ সালের অক্টোবরে ১৭ বছর বয়সে বার্সেলোনার মূল দলে তাঁর অভিষেক ঘটে। তআর পেশাদার ফুটবল জীবনের শুরুতে ইনজুরি-প্রবণ হলেও, ২০০৭ সাল এর দিকে তিনি নিজেকে দলের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেন। মেসি ২০০৭ সালের ব্যালন ডি’অর পুরস্কারে তৃতীয় ও ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কারে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। পরবর্তী বছর তিনি উভয় পুরস্কারে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন ও এর পরের বছর সে প্রথমবারের মত উভয় পুরস্কার জয় করেন। ২০০৮ ও ২০০৯ মৌসুমে তিনি বার্সেলোনার মূল দলের একজন নিয়মিত খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছিলেন । আর সে মৌসুমেই তিনি বার্সেলোনাকে প্রথমবারের মত ও প্রথম স্পেনীয় ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জয়ে অনেক সাহায্য করেন।
যদিও মেসির সেরা মৌসুম নিয়ে বিতর্ক আছে, আর তা থাকলেও পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে তাঁর সেরা মৌসুম ছিল ২০১১-১২। সেই মৌসুমে তিনি লা লিগা এবং ইউরোপীয় ফুটবলের ইতিহাসে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ সংখ্যক গোল করার কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন এবং বার্সেলোনার ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন মেসি তাঁর প্রতিভার আরেকটি ঝলক দেখা যায় ২০১৪-১৫ মৌসুেম, যখন তিনি লা লিগা ও উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতার কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। তিনি বার্সেলোনাকে ঐতিহাসিক দ্বিতীয় ট্রেবল জয়ে সাহায্য করেন। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে মেসি বার্সেলোনার অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। তবে বর্তমানে তিনি পিএসজি ক্লাব টির হয়ে খেলছেন।
জাতীয় দলেও তার অবদান কম নয়।মেসি আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা। বয়স ভিত্তিক পর্যায়ে তিনি আর্জেনটিনাকে ২০০৫ ফিফা ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতাতে সাহায্য করেছিলেন এবং সেই প্রতিযোগিতায় তিনি সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার অর্জন করেন। তাছাড়াও তিনি ২০০৮ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে আর্জেন্টিনার হয়ে ফুটবলে স্বর্ণপদক জয় লাভ করেন। তার আর্জেনটিনার জাতীয় দলে অভিষেক হয় ২০০৫ সালের অগাস্টে।
২০০৬ সালে ফিফা বিশ্বকাপ এ গোল করার মধ্য দিয়ে তিনি সর্বকনিষ্ঠ আর্জেন্টাইন হিসেবে বিশ্বকাপে গোল করার কৃতিত্ব অর্জন করেন। আবার এক বছর পর ২০০৭ সালে কোপা আমেরিকায় তিনি সেরা যুব খেলোয়াড়ের পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। ওই আসরেই আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিল। ২০১১ সালের আগস্টে তিনি আর্জেন্টিনা দলের হয়ে প্রথম অধিনায়কত্ব এর দ্বায়িত্ব পালন করেন।
অধিনায়ক এর দ্বায়িত্ব পালনের সাথে তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে টানা তিনটি প্রতিযোগিতার ফাইনাল খেলেছেন। ২০১৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপ, ২০১৫ সালের কোপা আমেরিকা ও ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকা। তিনি ২০১৪ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল পুরস্কার জয় করেন। তিনি ২০১৬ সালে জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। তবে ঠিক কয়েক মাস পরেই তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত বদলে পুনরায় জাতীয় দলে ফিরে আসেন এবং ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলায় তিন গোল করে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন। ২০১৮ সালের ফিফা বিশ্বকাপ, ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকায় তিনি তার দলকে নেতৃত্ব দেন। কোপা আমেরিকা ২০২১ সালে আর্জেন্টিনা তার নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। বর্তমানে তার দল ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে অতন্ত্য ভালো খেলেছে এবং ফাইনাল নিশ্চিত করেছে।