স্বামী নির্যাতন চালাতেন। তাই, একমাত্র শিশুকন্যাকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন স্বপ্না খাতুন। বাবার সংসারেও অভাব, বাস করেন নদীর চরে। স্বপ্নার স্বপ্ন ছিল, বিদেশে গিয়ে অনেক অর্থ উপার্জন করবেন। পরিবারের সচ্ছলতার স্বপ্ন পূরণ করবেন। কিন্তু, সে স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে সৌদি আরবে গিয়ে অন্ধ ও পঙ্গু হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। গৃহকর্ত্রীর নির্মম নির্যাতনে দৃষ্টিশক্তি হারানোর পাশাপাশি চলাচলের ক্ষমতাও হারিয়েছেন স্বপ্না খাতুন।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা পূর্বপাড়া গ্রামের ইলেক্ট্রনিক্স মিস্ত্রি আমিনুর রহমান সরদারের মেয়ে স্বপ্না খাতুনের এমন পরিণতি মেনে নিতে পারছে না পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী। তারা স্থানীয় দালালসহ নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
পরিবারের সদস্যরা জানান, দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে ২০২২ সালের নভেম্বরে স্থানীয় দলাল আশাশুনি এলাকার আল মামুনের (চিকু) মাধ্যমে সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ করতে যান স্বপ্না খাতুন। গৃহকর্ত্রীর হাতে চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে অন্ধত্ব আর পঙ্গুত্বকে সঙ্গী করে দেশে ফিরেছেন তিনি। কারণে-অকারণে সৌদি গৃহকর্তা মাকসুদ আলম ও তার স্ত্রী সোহাগ অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছেন স্বপ্না খাতুনের ওপর। তারা স্বপ্নার হাতে ও শরীরে বিভিন্ন স্থানে আয়রণ মেশিনের তাপে ঝলসে দিয়েছেন। মাথায় মারাত্মক আঘাত করায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন স্বপ্না খাতুন।
স্বপ্না খাতুন জানান, ঢাকার বনানীর নাওভিশন এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবে যান তিনি। সৌদি আরবের রিয়াদের আলহাদি গ্রামের ১৩ নম্বর সড়কের ১৩ নম্বর বাসায় মাকসুদ আলমের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন।
তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। সৌদি আরবে গিয়েছিলাম ভাগ্য বলাতে। কিন্তু, যে বাসায় কাজ করতাম সেখানে নির্যাতন করত। মারপিট করত, খেতে দিত না, ঘুমাতে দিত না। সারাক্ষণ কাজ করতে হতো। এ অবস্থায় খাদিজা নামের এক আপু আমার কাছে ৪০ হাজার টাকা চেয়েছিল। বলেছিল, পার্লারে কাজ দেবে। আমি তার কথামতো পালিয়েছিলাম। এ অবস্থায় পুলিশ আমাকে আটক করে। আমার বাসার মালিক আইনজীবী। তিনি আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাদের মারপিটে অন্ধ হয়ে পড়লে চিকিৎসার নামে আমাকে সৌদি এয়ারপোর্টে ফেলে রেখে গিয়েছিল। সেখানে দুজন মানুষ আমাকে উদ্ধার করে। বিস্তারিত শুনে তারাই আমাকে বাবা-মার কাছে দিয়ে গেছেন। আমি ওই বাসামালিকসহ নির্যাতনকারীদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। চিকু নামের এক দালাল আমাকে পাঠিয়েছিল। আমার এ অবস্থার খবর পেয়েও একবারও দেখতে আসেনি।
স্বপ্না খাতুনের মা আশুরা বেগম বলেন, সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশ আসা এক যাত্রীর কাছ থেকে মোবাইল ফোনে জানতে পেরে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে গুরুতর আহত মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসি। তার এখন উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।
বাবা আমিনুর রহমান বলেন, স্বামী স্বপ্নার ওপর অত্যাচার করত। তাই, স্বপ্নাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। আমার আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় মেয়ে ভাগ্য বদলানোর স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে যায়। সেখানে গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনে প্রতিবন্ধী হয়ে বাড়ি ফিরেছে। মেয়ের উন্নত চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা খরচ করতে হবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এ ঘটনায় জড়িত এজেন্সিসহ সৌদি নাগরিক মাকসুদ আলমকে আইনের আওতায় আনতে হবে। আর যেন কেউ এই নির্মম নির্যাতনের শিকার না হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করি।
এলাকাবাসী বলেন, স্বপ্না খাতুনের পরিবার অসচ্ছল হওয়ায় অর্থ উপার্জনে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে যে বাসায় কাজ করতেন, সেই বাসার মালিক নির্মম নির্যাতন করেছে। ফলে, তার চোখ দুটি নষ্ট হয়ে গেছে। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছ্যাকা দেওয়া হয়েছে। স্বপ্না এখন প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছে। এ ঘটনায় আমরা হতবাক। সে যাতে উন্নত চিকিৎসা পায়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আমরা বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে সৌদি সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সাতক্ষীরা জেলা সমন্বয়ক মো. হুমায়ুন রশিদ বলেন, আমরা আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতার জন্য স্বপ্নার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছি। পরবর্তীতে ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দেবো, যাতে তিনি স্বাবলম্বী হতে পারেন।
আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বলেন, রুটি-রুজির জন্য স্বপ্না খাতুন সৌদি আরবে যান। সেখানে তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ক্ষতিপূরণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে সৌদি সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। আর কেউ যাতে এভাবে প্রতারিত না হয়, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে সকলের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।