এই বসন্তে চুলের যত্নে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট ডার্মাটোলজিস্ট ডা: তাওহীদা রহমান ইরিন। তিনি এই বিষয়ে শুরুতেই বলেন, অনেকে আমাকে বলছেন যে, আমার চুলে আগে কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু হঠাৎ করে চুল পরার সমস্যা বেড়ে গেছে।অনেকে আবার বলছেন, আগে থেকে চুল পরার সমস্যা ছিল এখন মনে হয় একটু বেশি বেড়ে গেছে। অনেকে তো আবার এটা থেকে সমাধান পাওয়ার জন্য চুল শেভ করে ফেলার কথা বলছেন। শুধু শিশুরা না, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরাও এই সময় চুল শেভ করে ফেলছে। এটি কিন্তু কোনো সমাধান না। অনেকে আবার বলছেন যে, করোনাকালীন আমার চুল পাকা যেন বেড়ে গেছে। আগে চুলটা এরকম সাদা হতো না কিন্তু কালো চুলের মাঝে এক গুচ্ছ সাদা চুল হঠাৎ করে দেখতে পাচ্ছি।
প্রশ্ন উঠতে পারে কোভিড -১৯ মহামারী এবং চুল পরা – আসলে কি এর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে ? এর উত্তরে জানা যায়, অ্যামেরিকান একাডেমি অফ ডার্মাটোলজি এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউশন অফ স্কুলের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা কোভিড পজেটিভ ছিলেন তাদের ৫০% রোগী পরবর্তীতে চুল পরার সমস্যা নিয়ে ডাক্তারদের কাছে ভিজিট করেছেন। এর কারণ হচ্ছে, এতে শরীরে নানা ধরণের প্রদাহ ঘটেছে বা সাইটোকাইন স্ট্রর্ম হয়েছে যার ফলে এই হেয়ার লস হয়েছে। তবে হেয়ার লসটা সাধারণত কোভিড পজেটিভের সাথে সাথে না, ৫০-৬০ দিন পর দেখা দেয়। একে আমরা একটা প্যাটার্ন হেয়ার লস বলি যাকে বলা হয় টেলোজেন ইফ্লুভিয়াম।
শুধু কোভিড -১৯ কেন ? আমরা অনেকেই জানি যে, টাইফয়েড, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এই ধরনের জ্বরের পরেও কিন্তু হেয়ার লস দেখা দেয়। কোভিড -১৯ও তার ব্যতিক্রম নয়। অনেকে আছে যে তাদের কোভিড নেগেটিভ ছিলেন, কিন্তু তারপরও চুল পরছে। কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ইমোশনাল স্ট্রেস একটা বড় কারণ। সবাই ভাবছে যে, আমরা কি আবার স্বাভাবিক জীবন-যাত্রায় ফিরে যেতে পারবো ?
করোনায় অনেকে হারিয়েছে তার প্রিয়জন। এই যে ট্রমা, এসব কারণে হেয়ার লস হচ্ছে।
আমাদের বায়োলজিক্যাল ক্লক যেটিকে বলা হয় যে রাতে ঘুমানো দিনে জেগে থেকে কাজ করা। দীর্ঘদিন লকডাউনে থাকার কারণে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম – নানা কারণে দেখা গেছে অনেকে সারারাত জেগে থাকছে এবং দিনের বেলা ঘুমোচ্ছে। এটি কিন্তু শুধু চুল কেন শরীরের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনছে না। হেয়ার লস বেড়ে যাচ্ছে। অনেকে ভাবছেন যে অনেক দিন ধরে ঘরে বসে আছি একটু সময়টাকে কাজে লাগাই। আমরা এক্সট্রা ওজনটাকে কমিয়ে ফেলি। এর ফলে করছেন কি, তারা না জেনে ক্র্যাশ ডায়েট করছে, না বুঝে মিল স্কিপ করছেন। ইন্টারনেট ঘেটে হয়তোবা কিছু ডায়েট ফলো করছেন। ওজন তাদের কমছে কিন্তু বিনিময়ে তারা ক্ষতি করছেন নিজেদের চুলের এবং শরীরের।
আর চুল পেকে যাওয়ার কারনে যেটা দেখা যায় যে, আমাদের শরীরের যেটি হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বা ব্লিচিং এজেন্ট থাকে সেটিকে শরীরের ক্যাটালেইজ নামক এক ধরণের এনজাইম কমিয়ে রাখে। কিন্তু স্ট্রেসের কারণে এই ক্যাটালেইজ কমে যাচ্ছে এবং হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বেড়ে গিয়ে আমাদের প্রিম্যাচিউর গ্রে হেয়ার বা চুল পেকে যাওয়া, অকালপক্কতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনেকে না বুঝে বাসায় বসে চুলে নানা ধরণের কেমিক্যাল ট্রিট করছে, এক্সপেরিমেন্ট করছে, ব্লিচ করছে, কালার করছে। সে কালারগুলো হয়তো চুলের জন্য ভালো না, সে কারণে হেয়ার লস হতে পারে।
আমরা ডার্মাটোলজিস্টরা এই ধরণের হেয়ার প্রবলেম থাকলে যেভাবে সলিউশন দিয়ে থাকি :
#প্রথমে তাদের হিস্ট্রি জেনে নেই, যারা আগে থেকেই অ্যান্ড্রোজেনিক অ্যালোপেশিয়া, বংশগত কারণ, ডায়াবেটিস বা দীর্ঘদিন ধরে থাইরয়েড ডিজ অর্ডার, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম এ সমস্যাগুলোতে ভুগছেন এবং এই সময় টেলোজেন ইফ্লুভিয়াম অর্থাৎ হঠাৎ করে হেয়ার লস হচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে আমরা রোগগুলো কন্ট্রোল বা মনিটর করার কথা বলছি এবং সেই সাথে নানা ধরণের এডভান্স ট্রিটমেন্ট দিয়ে দিচ্ছি। এবং সেই সাথে একটু হেয়ার কেয়ার রুটিন এডোপ্ট করতে বলছি।
হেয়ার কেয়ার রুটিনে কি থাকছে :
#আমরা সবাই জানি যে, চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াই, টাওয়েল দিয়ে চুল মুছি এবং শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, তেল ব্যবহার করি। তবে এগুলোর ক্ষেত্রে একটু পার্টিকুলার হতে হবে। আমরা ওয়াইড টুথ কম্ব ইউজ করতে এবং মাইক্রোফাইবার যুক্ত সফট টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে বলি। হেয়ার ড্রায়ার বা হিটিং কোনো প্রসেসে না গিয়ে ফ্যানের বাতাসে চুল শুকানোটাই চুলের জন্য উপকারী। এছাড়া শ্যাম্পু হিসেবে আমরা বলি যে সল্ট, সালফেট এবং প্যারাবেন ফ্রি শ্যাম্পু ব্যবহার করতে। যাদের চুলে একটু খুশকি আছে তারা এন্টি-ড্যান্ড্রাফ শ্যাম্পু ব্যবহার করবেন ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী। যাদের চুল পরে যাচ্ছে, নানা ধরণের বোটানিক্যাল এক্সট্রাক্ট এবং রিগ্রোথ ফ্যাক্টর যুক্ত হেয়ার রিগ্রোথ শ্যাম্পু পাওয়া যায় সেগুলো ব্যবহার করবে। যাদের চুল কেমিক্যালি ট্রিটেড, রিবন্ডিং করা বা কালার করা তারা কেমিক্যালি ট্রিটেড কোনো মাইল্ড শ্যাম্পু ব্যবহার করবে। কালারের ক্ষেত্রে ন্যাচারাল কালার চুজ করবেন। ন্যাচারাল মেহেদিটাকেই আমরা প্রিফারেবল বলি এবং এমোনিয়া ফ্রি কালার ব্যবহার করবেন। কারণ অ্যামোনিয়া যুক্ত কালার কিন্তু চুলের ক্ষতি করে ফেলে।
এছাড়াও আমরা নানা ধরণের সাপ্লিমেন্ট দিয়ে থাকি। সেই সাপ্লিমেন্টগুলো সাধারণত আমরা এনালাইসিস করে দেখি যে তার কোনো ভিটামিন ডি, জিংক, বি-কমপ্লেক্স, আয়রণ এগুলোর ঘাটতি আছে কি না। এগুলো ঘাটতি থাকলে সাপ্লিমেন্ট দিয়ে সেগুলো ফিল আপ করার চেষ্টা করি। ভিটামিন ডি, জিংক, বি-কমপ্লেক্স, সেলেনিয়াম, আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার খেতে বলি। ডিম, ঢেঁকি ছাটা চাল, ওটস, টমেটো, গাঁজর, দুধ, টক দই, ছোটো মাছ, নানা ধরণের সামুদ্রিক মাছ এবং বীজ এগুলোকে কিন্তু আমরা হেয়ার ফ্রেন্ডলি ফুড বলে থাকি। এগুলো খেলে আমাদের চুলের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। এরপরেও আমরা এডিশনাল কিছু সাপ্লিমেন্ট দিয়ে থাকি যেগুলোতে আছে এসেনশিয়াল অ্যামাইনো এসিড, জিনসেং এক্সট্রাক্ট, নেটেল লিভস, পালমেতো। আধুনিক কিছু সাপ্লিমেন্ট আছে যেগুলো চুলকে গ্রোথেও হেল্প করে, প্রিম্যাচিউর গ্রে হেয়ারটাকেও কমিয়ে আনে ও মাথার ত্বককেও স্বাস্থ্যকর রাখে।
টপিক্যাল সলিউশন যেমন হেয়ার ফুড, হেয়ার এসেন্স, হেয়ার সেরাম, হেয়ার টনিক এগুলো আমরা এপ্লাই করার পরামর্শ দেই। আর এডেনোসিন, মিনোক্সিডিল, ক্যাফেইন জেল এগুলোও আমরা অনেক সময় টপিক্যালি ব্যবহার করতে বলি। তবে এগুলো অবশ্যই আমরা এনালাইসিস করে দেখি কোনটি কার জন্য স্যুট করবে কারণ সবাইকে যে সকল ধরণের হেয়ার টনিক বা টপিক্যাল সলিউশন স্যুট করবে তা না। আর আধুনিক ট্রিটমেন্টের মধ্যে যারা ক্লিনিকে আসছে তাদেরকে আমরা পিএ পিআরপি, হেয়ার ফিলার, মাইক্রো নিডলিং, লেজার থেরাপি এগুলোর মাধ্যমে সমাধান দেয়ার চেষ্টা করছি।