পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য দেশের মধ্যে মধ্য ইউরোপের ছোট্ট একটি দেশ ‘লিশটেনস্টাইন’ (Liechtenstein)। সুইজারল্যান্ড এবং অস্ট্রিয়ার মধ্যবর্তী অবস্থান দেশটির। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ষষ্ঠ এবং ইউরোপের চতুর্থ ক্ষুদ্রতম দেশ এটি। মাত্র ১৬০ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে এর আয়তন। দৈর্ঘ্যে প্রায় ২৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থে প্রায় ১২ কিলোমিটার। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, দেশটির আয়তন বাংলাদেশের যেকোনো জেলার আয়তনের চাইতেও কম। মাত্র ১৭,০০০ লোকের বাস এই দেশে।
ভাদুজ বা ফাদুৎস (vaduz) হলো দেশটির রাজধানী যার আয়তন মাত্র ১৭ বর্গ কিলোমিটারের মতো। এই রাজধানীতেই বাস প্রায় ৬,০০০ মানুষের। লিশটেনস্টাইনের দক্ষিণ আর পশ্চিমদিকে সুইজারল্যান্ড এবং উত্তর আর পূর্বদিকে রয়েছে অস্ট্রিয়া। ইউরোপের দীর্ঘতম রাইন নদী এঁকেবেঁকে চলেছে দেশের পশ্চিমপ্রান্ত দিয়ে। আর এর পূর্বপ্রান্তে রয়েছে আল্পস পর্বতমালা।
রাইন নদী বয়ে চলেছে লিশটেনস্টাইন; Image Source: eurotripadventures.com
দেশটির চারপাশে রয়েছে পাহাড়ি প্রকৃতির অপরূপ ছোঁয়া। ভাদুজ শহরে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা রয়েছে ভাদুজ ক্যাসেল বা ভাদুজ দুর্গ। এটি যেন পুরো রাজধানীর প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। শহরের প্রায় যেকোনো জায়গা থেকে এই দুর্গের দেখা পাওয়া যায়। এই দুর্গেই বাস করেন দেশটির রাজারানি। সাধারনের প্রবেশ নিষেধ এই দুর্গে। আর দুর্গ থেকে যে রাস্তাটি মূল শহরে মিশেছে তার নাম স্কলসওয়েগ। ভ্রমণের জন্যে তেমনভাবে আলোচিত না হলেও দেশটিতে রয়েছে অপার সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি।
ছোট হলেও দেশটির রয়েছে বেশ প্রাচীন ইতিহাস। দেশটির রাজধানী ভাদুজের প্রাচীন নাম ছিল ফার্দুজেস। ১৩২২ সালে গড়ে ওঠে ভার্দুজ দুর্গ। ১৩৪২ সালে ওয়েরডেনবার্গ প্রদেশের শাসকদের হাতে এই দেশের গোড়াপত্তন হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৪৯৯ সালের দিকে সোয়াবিয়ার যুদ্ধে সুইস রাজারা ভাদুজ আক্রমণ করে দখল করে। ১৭ শতকের দিকে লিশটেনস্টাইনের বর্তমান শাসক পরিবাররা ভাদুজে আসেন। পরবর্তীকালে যুবরাজ জোহান অ্যাডাম আনড্রিয়াস সেলেনবার্গ এবং ভাদুজকে একত্র করে ১৭১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে লিশটেনস্টাইনকে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু ১৭১৯ সালে রোমান সম্রাটরা নিজেদের অধীনে এই অঞ্চলের শাসনভার তুলে নেন। প্রায় ১০০ বছরের কাছাকাছি শাসন করার পর ১৮০৬ সালে দেশটিকে পরিপূর্ণ স্বাধীন ঘোষণা করা হয়।
১৯৩৮ সাল থেকে রাজা ভাদুজ দুর্গকে পাকাপাকি বাসস্থান হিসেবে গড়ে তোলে। যুবরাজ ফ্রান্স জোসেফ (দ্বিতীয়) ছিলেন এই দুর্গের প্রথম বাসিন্দা। তার আমল থেকেই এই দুর্গে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তার মৃত্যুর পর ১৯৮৯ সালে রাজপুত্র হান্স অ্যাডাম (দ্বিতীয়) এই দেশের শাসনভার তুলে নেন। রাজার অধীনে দেশটির পার্লামেন্ট চলে, যেখানে ২৫ জন মন্ত্রী বা সংসদীয় সদস্য রয়েছে যাদের মেয়াদ চার বছর পর্যন্ত। এছাড়াও দেশটির ১১টি পৌরসভা জুড়ে প্রায় ৬০০টির মতো ক্লাব রয়েছে।
ভাদুজের নতুন পার্লামেন্ট ভবন; Image Source: videoblocks.com
মজার ব্যাপার হলো ইউরোপের অন্যান্য অনেক দেশের মতো এই দেশেরও নিজস্ব কোনো সামরিক শক্তি নেই। দেশটির নিরাপত্তা অবস্থা বিচার করে ১৮৬৮ সালের পর থেকে সেনাবাহিনী পুরোপুরিভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়। তবে সেনাবাহিনী না রাখার ব্যাপারে মূলত অর্থনৈতিক দিকটাই প্রাধান্য পেয়েছে। প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলা এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ করা, পাশাপাশি অস্ত্রশস্ত্র কেনা বেশ ব্যয়বহুল। সেই কারণে দেশটি থেকে সেনাবাহিনী পুরোপুরি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দেশটির সার্বিক আইনশৃঙ্খলার তত্ত্বাবধানে কেবল ‘ন্যাশনাল পুলিশ প্রিন্সিপালিটি’ নামে একটি পুলিশ বাহিনী রয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও যেকোনো ধরনের নিরাপত্তাজনিত সাহায্য সহযোগিতা সুইজারল্যান্ড দিয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়।
১৫ আগস্টকে দেশটিতে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনটি মূলত পুরো দেশের আনন্দ উৎসবের দিন। দুর্গের প্রাঙ্গনে দেশবাসীরা একত্র হয়। দুর্গের সামনেই বসে মেলা এবং ভিন্ন ধরনের নাচ-গানের আসর। এছাড়াও সন্ধ্যেবেলা দুর্গের মাঠে আতশবাজির প্রদর্শন হয়। রাজার পক্ষ থেকে সবাইকে ওয়াইন পরিবেশন করা হয়। সকল অতিথিদের আনন্দ উৎসবে রাজাও সামিল হন।
লিশটেনস্টাইনের বর্তমান রাজার পুরো নাম জোহানেস অ্যাডাম ফার্দিনান্দ আলোয়াস জোসেফ মারিয়া মার্কো ডিভিও পাইওস বা সংক্ষেপে হান্স অ্যাডাম (দ্বিতীয়)। তার জন্ম হয় ১৯৪৫ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি। তার পিতা ফ্রান্স জোসেফ (দ্বিতীয়) ১৯০৬ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত লিশটেনস্টাইন শাসন করেন। তার মায়ের নাম হলো কাউন্টেস জর্জিনা ভন উইলকজার। হান্স অ্যাডামের জ্যেষ্ঠ পুত্র এলয়েস ফিলিপ মারিও হবেন পরবর্তী যুবরাজ।
দেশটিতে সুইস ফ্রাঁ ও ইউরো মুদ্রার প্রচলন রয়েছে। এই দেশটির নিজস্ব কোনো ভাষা নেই। দেশের সর্বত্র জার্মান ভাষার প্রচলন রয়েছে। এছাড়াও ফরাসি ও ইংরেজির ব্যবহারও লক্ষ করা যায়। লিখলেস্টাইন মূলত শীতপ্রধান দেশ। শীতের সময় খুব ঘন ঘন তুষারপাত হয় এখানে। বরফে ঢেকে যায় পাহাড়ি সব উপত্যকা আর গাছগাছালি। গ্রীষ্মকালে হালকা ঠাণ্ডা এবং মাঝারি উষ্ণ আবহাওয়া থাকে।
ঘোরার জন্যে সেনজেন ভিসা নিয়েই এই দেশে প্রবেশ করা যায়। বাংলাদেশের সময় থেকে লিশটেনস্টাইনের সময় ব্যবধান প্রায় চার ঘণ্টা। সুইজারল্যান্ডের মতোই এই দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা বেশ উন্নত। ছোট্ট দেশটিতে প্রায় ১৫টি ব্যাংক রয়েছে। দেশটির মোট জিডিপি’র এক-চতুর্থাংশ আসে এই ব্যাংকিং খাত থেকে। এর মধ্যে বহু ব্যাংক বিদেশী কোম্পানির বাণিজ্যিক সেবাও প্রদান করে থাকে। এছাড়াও কৃত্রিম দাঁত তৈরি এবং সংস্থাপনে লিশটেনস্টাইন প্রথম অবস্থান ধরে রেখেছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বা ব্যবসায়িকভাবেও দেশটির বেশ গুরুত্ব রয়েছে। সুইজারল্যান্ড থেকে মাত্র ৪১.১ কিমি এবং অস্ট্রিয়া থেকে মাত্র ৩৪.৯ কিমি দূরত্বে দেশটির অবস্থান। দেশটির মধ্যে ৩০টিরও বেশি বড় বড় কোম্পানি রয়েছে যাতে প্রায় ৮০০০ লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণায় দেশটির উন্নতি দৃশ্যমান। দেশটিতে চারটি গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং নয়টি উচ্চবিদ্যালয় রয়েছে।
লিশটেনস্টাইনের নিজস্ব কোনো বিমানবন্দর নেই। তবে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে সুইজারল্যান্ড এবং ৮৫ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে জার্মানির এয়ারপোর্ট। লিশটেনস্টাইনের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব উন্নত। এখানে রয়েছে ব্যাটারিচালিত সিটি ট্রয় ট্রেন। দু’কামরার এই ট্রেনে করে ঘুরে আসা যায় ভাদুজের পুরনো শহর, প্রান্তর বিস্তৃত আঙুরক্ষেত, প্যানোরোমা ভিউ পয়েন্ট, রাইন পার্ক স্টেডিয়াম, ভাদুজ সিটি সেন্টার আরো কত কী! এছাড়াও এখানে বেশ ভালো বাস পরিবহন সুবিধা রয়েছে। এছাড়াও দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্সি সুবিধা।
ভাদুজ থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে লিশটেনস্টাইনের দক্ষিণ-পূর্বে আল্পস পর্বতের দক্ষিণ গিরিশিরায় গড়ে উঠেছে অনন্য সুন্দর এক গ্রাম মালবুন। এখান থেকে চারপাশে বহু হিমশৃঙ্গের দেখা মেলে। ছবির মতো সুন্দর এই গ্রাম, যেখানে রয়েছে ১৯৫০ সালে নির্মিত চ্যাপেল অফ পিস। মালবুনের পাহাড়ে বা উপত্যকায় শীতের সময় বরফ জমে গেলে স্নো-বোর্ডিং, হাইকিং, বাইকিং আর স্কিয়িংয়ের জমজমাট আসর বসে। এখান থেকেই ২ কিলোমিটার দূরে অস্ট্রিয়ার সীমান্ত। এছাড়াও সোলেনবার্গ ও ট্রাইসেনবার্গ পাহাড়ি ও পুরনো জনপদগুলোর মধ্যে অন্যতম।
লিখলেস্টাইনের দক্ষিণ পূর্বের ছোট্ট একটি গ্রাম; Image Source: is-link.org
লিশটেনস্টাইনের ওয়াইন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। নিজস্ব আঙুরক্ষেত থেকে আঙুর ব্যবহার করে বিভিন্ন স্বাদের ওয়াইন তৈরি করা হয়ে থাকে। শীতপ্রধান দেশ বলে এধরনের পানীয়ের চাহিদাও বেশি। এছাড়াও এখানে কিছু রেস্তোরাঁ রয়েছে, যাদের মধ্যে ম্যাকডোনাল্ড খুব জনপ্রিয়।
লিশটেনস্টাইনের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে ঈগল এডভেঞ্চার হাইক, ট্রেজার চেম্বার অফ দি প্রিন্সিপলিটি অফ লিশটেনস্টাইন, দ্য টাউন সেন্টার অফ ভাদুজ, লিশটেনস্টাইন মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস, দ্য প্রিন্স অফ লিখলেস্টাইন ওয়াইনারি, লিশটেনস্টাইনসিস ল্যান্ডসেমুয়েজিয়াম, হিলি আর্ট ফাউন্ডেশন, রাগেলার রায়েট নেচার রিজার্ভ ইত্যাদি। ছোট এই দেশে প্রবেশের তেমন কোনো বাধা-নিষেধ না থাকার কারণে দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ভ্রমণ পিপাসুদের জন্যে।