বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যা যেন কানাডার টরন্টোর শেকড়ের সাথে জড়িত; বহু সংস্কৃতি ও নিত্যনতুন উদ্ভাবন মিলে অনবদ্য এক চরিত্র গড়েছে এ নগরীর। বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সুবাদে বাংলাদেশি-কানাডিয়ানরাও এ শহরের সাথে বিশেষ সম্পর্ক গড়তে পেরেছেন।
বাংলাদেশে টরন্টোর পরিচিতি প্রধানত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী হিসেবে সেখানে অবস্থানের সুবিধাদি এবং কুখ্যাত বেগম পাড়া – এ দুই কারণে। কিন্তু, তৃতীয় আরেকটি দিকও আছে, যা প্রায়ই নজর এড়িয়ে যায়। সেটা হলো, প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণদের সাফল্যের গল্পগুলো; নতুন বাসস্থান হিসেবে বেছে নেওয়া এই শহরে যারা ইতিবাচক অবদান রেখে চলেছেন। বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক দূত হিসেবে ব্যক্তিগত মেধা-মনন ও যোগ্যতায় তারা জন্মভূমির স্বতন্ত্র এক পরিচয় গড়ে চলেছেন।
এমনই তিন তরুণ – আহনাফ, নবনীতা ও ইসার সাফল্য অভিমুখে পথচলার কাহিনি তুলে ধরতে এ আয়োজন। টরন্টোর সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যারা রাখছেন নিজস্ব প্রতিভার স্বাক্ষর। তাদের চলার পথ ভিন্ন হয়েও যেন একই সূত্রে গাঁথা; যা তুলে ধরে তাদের উচ্চাকাঙ্খা, অদম্যতা ও সৃজনশীলতার গল্প।
আহিরি’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা আহনাফ আলী
সবার জন্য ডিজাইনার ফ্যাশন সহজলভ্য করার লক্ষ্যে পরিচালিত কানাডার উদীয়মান একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড আহিরির সহ-প্রতিষ্ঠাতা আহনাফ আলী। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর ফ্যাশনের প্রতি গভীর আগ্রহ থেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার এই যাত্রা শুরু তার।
টরন্টো-ভিত্তিক সরাসরি ভোক্তা-পর্যায়ে সরবরাহকারী নারীদের পোশাকের ব্র্যান্ড আহিরি। সমসাময়িক ও ডিজাইন-নির্ভর ফ্যাশন পণ্যই তাদের মূল বৈশিষ্ট্য, যার মাধ্যমে গ্রাহকের দৈনন্দিন পোশাকে বৈচিত্র্য আনতে চায় তারা। আহিরির মৌসুমি পোশাকের কালেকশনে মান ও টেকসইতায় তাদের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন দেখা যায়। পোশাকে উন্নতমানের প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার ও ‘আবেগের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা শৈল্পিক নিপুণতা’ যোগ করে স্বতন্ত্র এক ধারা।
আহনাফ বলেন, ‘উত্তর আমেরিকার ফ্যাশনপ্রেমী, যারা ব্যতিক্রমী দামে নতুন ডিজাইনের পোশাক খোঁজেন এবং তার কদর করেন – তারাই আমাদের গ্রাহক। শুরুতে আহিরির লক্ষ্য ছিল কানাডার সমসায়িক ফ্যাশন বাজারে অনন্য, সংগ্রহে রাখার মতো ডিজাইন সরবরাহ করা। কিন্তু, বর্তমানে ব্র্যান্ডটি উত্তর আমেরিকার ক্রমবর্ধমান তরুণ পেশাজীবীদের চাহিদা মেটানোর মাধ্যমে নিজস্ব এক বাজার খুঁজে পেয়েছে।’
আহনাফের মতে, যে বিষয়টি আহিরিকে অন্যদের থেকে ব্যতিক্রমী করেছে, সেটা হলো বাংলাদেশের সাথে এর যোগসূত্র এবং বাংলাদেশের প্রস্তুতকারক খাত সম্পর্কে বিদেশিদের প্রচলিত যে ধ্যান-ধারণা, তা আমূল বদলে দেওয়া।
‘বাজার ও সংগ্রহের উৎসে এই ধ্যানধারণা বদলে দেওয়া নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি’ বলেন তিনি।
উন্নত মানের পোশাক পণ্য সাধারণত ইউরোপ ও চীনে প্রস্তুত হয়- এমন একটা ধারণা রয়েছে পশ্চিমে। যাকে চ্যালেঞ্জ করতেই একটি কারখানায় উচ্চ মানের পোশাক প্রস্তুত করছে আহিরি। বাংলাদেশে এই কারখানার কর্মীদের আর্থিকভাবে ক্ষমতায়ন ও জীবনমান উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আহিরি।
কারখানার ৯৭ শতাংশ কর্মীই হলেন নারী। তাদের কর্মক্ষেত্রে শিশুর পরিচর্যা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, আইনি সহায়তাসহ নানা সুবিধা দিয়ে থাকে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
অর্থাৎ, আহিরি শুধু মানসম্পন্ন ফ্যাশনেই যত্নশীল নয়, এই ব্যবসার সামাজিক প্রভাব সম্পর্কেও সচেতন। ফ্যাশনের মাধ্যমে উৎপাদন কর্মীদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চায় এই ব্র্যান্ড। আহিরির লক্ষ্য তাই বিবেকচালিত ফ্যাশন ব্যবসা, যেখানে যত্নের সেলাই বুনবে টেকসই ভবিষ্যৎ।
এইচডিএএক্স থেরাপিউটিক্স- এর প্রধান নির্বাহী ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা নবনীতা নাওয়ার
এইচডিএএক্স থেরাপিউটিক্স- এর প্রধান নির্বাহী ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা নবনীতা নাওয়ার নিউরোলজিক্যাল ও হৃদরোগের সর্বাধুনিক চিকিৎসা উদ্ভাবনে তার টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
বর্তমানে নবনীতা পিএইচডি করছেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে, এই শিক্ষাকেন্দ্র থেকেই তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেছিলেন।
৯ বছর আগে কানাডায় পাড়ি জমানোর আগে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নবনীতার আগ্রহের শুরুটা হয় ঢাকাতেই। প্রিয়জনের ক্যান্সারের সাথে লড়াইয়ের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতাই তার চালিকাশক্তি, যা তাকে মলিকিউলার বায়োলজি, এভ্যুলেশনারি বায়োলজি ও মেডিসিনাল কেমিস্ট্রির মতো বৈজ্ঞানিক গবেষণার নানা ক্ষেত্রে উৎসাহ দিয়েছে।
এসব বিষয়ে অধ্যয়নের ফলাফল থেকে উৎসাহিত হয়েই দূরারোগ্য বিভিন্ন ক্যান্সারের থেরাপি উদ্ভাবনের মিশনে নামেন নবনীতা। আর সেই সূত্রেই প্রতিষ্ঠিত হয় এইচডিএএক্স থেরাপিউটিক্স।
মানবদেহে ওষুধের পরীক্ষা হলো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। কিন্তু তার আগে প্রি-ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে কার্যকারিতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয় নিশ্চিত করতে হয়। এইচডিএএক্স থেরাপিউটিক্স প্রি-ক্লিনিক্যাল পর্যায়ের ওষুধ আবিষ্কারক কোম্পানি। তাদের মূল কার্যক্রম হলো – যেসব রোগের কার্যকর চিকিৎসা বর্তমানে নেই, সেগুলোর জন্য নতুন থেরাপি তৈরি।
চিকিৎসাধীন ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে কেমোথেরাপির ফলে নিউরোপ্যাথি দেখা দেয় – এতে প্রচণ্ড ব্যথা, অসারভাব, মাংশপেশির শিথিলতার মতো দুঃসহ যন্ত্রণা হয় তাদের। প্রাথমিকভাবে এই সমস্যা সমাধানেই গুরুত্ব দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
এই রোগের মূল কারণকে মোকাবিলা করার জন্য বিদ্যমান কোনো চিকিৎসা না থাকায় রোগীদের ব্যথানাশক বা ফিজিওথেরাপির ওপর নির্ভর করতে হয়। নবনীতা ও তার টিমের লক্ষ্য নিউরোপ্যাথির জন্য প্রথম রোগ-পরিবর্তনকারী চিকিৎসা তৈরির মাধ্যমে রোগীর পরিচর্যায় বিপ্লব ঘটানো।
উদ্দেশ্য মহৎ হলেও, অর্থের সংস্থান করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আর ওষুধ গবেষণাও জটিল প্রক্রিয়া। এসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে নবনীতার বক্তব্য, ‘একটি থেরাপিউটিক কোম্পানির জন্য তহবিল সংগ্রহ করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। কারণ ওষুধ নিয়ে গবেষণা বেশ দীর্ঘসময় ধরে চলে, এতে বিপুল অর্থেরও প্রয়োজন হয়। কিন্তু, যতদিন নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো আবিষ্কৃত ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতিকে রোগীর ওপর ব্যবহারের অনুমতি না দেয়, ততদিন কোন আয় বা মুনাফা হয় না।’
‘তবে প্রি-ক্লিনিক্যাল পর্যায়ের কোম্পানি হিসেবে আমরা সম্ভাব্য বাণিজ্যিক অংশীদারদের সাথে যুক্ত আছি, যাতে এই শিল্পের স্বার্থ/চাহিদার সাথে সঙ্গতি গবেষণা পরিচালিত হয়। আমাদের প্রাথমিক কিছু প্রচেষ্টা সফলও হয়েছে, ফলে আমরা একটি স্থিতিশীল আয়ের উৎস পাব বলে আশা করছি। পণ্যের আউট-লাইসেন্স ও কৌশলগত অংশীদারত্ব নিয়েও আমাদের আশাবাদ রয়েছে’।
যেসব রোগের কার্যকর চিকিৎসা নেই, তাদের নিরাময় আবিস্কারে এইচডিএএক্স থেরাপিউটিক্স একদিন বড় চালিকাশক্তি হবে এমন স্বপ্ন দেখেন নবনীতা। তার আরও লক্ষ্য কর্মক্ষেত্রে নারীকে সহায়তা দান এবং জৈবপ্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান সৃজনে অগ্রণী ভূমিকা রাখা।
জৈবপ্রযুক্তি খাতে বিপ্লব এবং নারীর ক্ষমতায়নের এই লক্ষ্য নিয়ে চিকিৎসার বিভিন্ন অগ্রগতিতে অবদান রাখছে কোম্পানিটি।
নবনীতার মতে, ‘আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের তৈরি সর্বপ্রথম চিকিৎসা সমাধানগুলো দিয়ে বিভিন্ন রোগব্যাধি মোকাবিলা করে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের জীবন বদলাতে ও বাঁচাতে ভূমিকা রাখতে পারব। সেজন্য আমাদের শক্ত ভিত্তিও রয়েছে।’
ফারুক ভাই প্রজেক্ট- এর ইসা ফারুক
বাংলাদেশি-কানাডিয়ান একজন সঙ্গীতশিল্পী ইসা ফারুক। ফারুক ভাই হিসেবেই সুপরিচিত তিনি। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশি সাউন্ডের প্রয়োগে সঙ্গীতে অনবদ্য ধারা আনছেন এই শিল্পী। তার সঙ্গীতধারা – বাংলা অলটারনেটিভ পপ হলো বিভিন্ন জনরার সুর ও সঙ্গীতের এক ফিউশন; যা নতুনত্বের স্বাদ দেয়, জাগায় অভিনব এক অনুভূতি।
ফ্রাঙ্ক ওশান, কেন্ড্রিক লামার, পবন দাস বাউল, জর্জ বেন জোর ও ডিসক্লোজারের মতো শিল্পীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ফারুক সঙ্গীতের যে ক্যারিয়ার বেছে নেন তার সুর লহরী গণ্ডি পেরিয়ে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
সঙ্গীতের হাতেখড়ি বা প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকায় হলেও, ইসার ক্যারিয়ারে ‘ব্রেক থ্রু’ আসে যখন মধ্য কৈশোরে আন্ডারগ্রাউন্ড মিউজিকের দুনিয়ার সাথে পরিচয় হয় তার। এরপর ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে যোগ দেন বেঙ্গলি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ব্যান্ডে।
এভাবেই সুরের ভুবনে যাত্রা শুরু হয় ইসা ফারুকের। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে পছন্দের বাদ্যযন্ত্র হয়ে ওঠে উকুলেলে– ফারুক ভাই প্রজেক্টের যাত্রা শুরু এভাবেই।
প্রবাসী শিল্পী হিসেবে বাংলাদেশি সঙ্গীতের বাইরেও তার অবাধ বিচরণ থাকায়, দক্ষিণ এশিয়ায় নিজস্ব সঙ্গীত বিপণনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন ফারুক। তারপরও অবশ্য তার সঙ্গীত বাংলাদেশের শ্রোতাদের মধ্যে সাড়া জাগাচ্ছে এবং দেশের দ্রুত-পরিবর্তনশীল সঙ্গীতের ভুবনেও অবদান রাখতে পারছে।
ফারুক বলেন, ‘আমরা সঙ্গীত বাংলাদেশে সমাদৃত হচ্ছে, এজন্য আমি দারুণ কৃতজ্ঞ। আমি টরন্টোবাসী হওয়ায় এখানকার বিশ্বমানের প্রযোজক ও স্টুডিও’র সুবিধা পাচ্ছি, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় নিজে না থেকে সেখানে সঙ্গীত বিপণন ও অর্থ উপার্জন করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। আমি সঙ্গীতে কোনো অবদান রাখতে পারছি কিনা – দিনশেষে সেই সিদ্ধান্ত নেবেন শ্রোতারাই।’
বর্তমানে প্রায় সকল জনরার বাংলাদেশি শিল্পীরা গৎবাঁধা ধারার বাইরে এসে নতুন সাউন্ড ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন।
‘গতানুগতিকতার আগল ভাঙ্গার বিষয়ে বলতে চাই, আমি কখনো বাংলাদেশের কোনো ব্যান্ডে বাজাইনি, বরং কানাডার এক ছোট্ট শহরে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র থাকার সময়ে বাংলা মিউজিক তৈরি শুরু করি। এতে অনেক কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় জড়িত ছিল, কিন্তু তারপরও যে সাড়া আমি পেয়েছি, তার জন্য কৃতজ্ঞ,’ যোগ করেন তিনি।
আহনাফ, নবনীতা ও ইসার কাহিনি বাংলাদেশি-কানাডিয়ান প্রবাসীদের অজানা গল্পগুলোর অংশ। যেখানে জড়িয়ে আছে উদ্ভাবনা, উদ্যোক্তা শক্তি, সৃজনশীলতার সেই বিচ্ছুরণ- যা টরন্টোরই বৈশিষ্ট্য। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে ছোটার সাথে সাথে নির্ভয়ে নিজ শেকড়কে আঁকড়ে ধরে রাখার অনুপ্রেরণাও দেয় তাদের এই অভিযাত্রা। আর হয়তো সেটাই আমাদের উপলদ্ধির এক বড় পাঠ।
লেখক: ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাক্স বেল স্কুল অফ পাবলিক পলিসিতে মাস্টার অব পাবলিক পলিসির ক্যান্ডিডেট মীর আফতাবউদ্দিন আহমেদ। তিনি পলিসি নিউজলেটার ‘দ্য বেল’ এর প্রধান সম্পাদক। ডেইলি স্টার, ঢাকা ট্রিবিউন এবং দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের একজন নিয়মিত কলামিস্টও তিনি।
যোগাযোগের ঠিকানা: aftab.ahmed@alum.utoronto.ca