মালয়েশিয়ার এবারের নির্বাচন বেশ জটিল এক সমীকরণের দিকে এগোচ্ছে। গতবারের নির্বাচনে যেখানে অনেকটাই দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল, সেখানে এবার সর্বত্র আনোয়ার ইব্রাহিম, জাহিদ হামিদি-ইসমাইল সাবরী, ডার্ক হর্স মহিউদ্দিন ইয়াসিন ও মাহাথির মোহাম্মদের চতুর্মুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর থাকতে হবে কে হতে যাচ্ছেন মালয়েশিয়ার ১৫তম প্রধানমন্ত্রী। তবে ফলাফল প্রকাশের পর চূড়ান্ত মেরুকরণে মালয়েশিয়ান রাজার গভীর ক্ষমতা বলয়ই শুধু নয়, সেইসঙ্গে প্রভাশালী কিছু বহিঃপক্ষের নেপথ্য ভূমিকাও এবার থাকতে পারে।
মালয়েশিয়ায় জনমত জরিপের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান মনে করা হয় মারদেকা অর্গানাইজেশনকে। সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর ১৯ থেকে ২৮ অক্টোবরের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি। এ সমীক্ষা অনুসারে ১৫তম সাধারণ নির্বাচনে ভোটারদের পছন্দের দিক থেকে আমনুর নেতৃত্বাধীন বারিসান ন্যাশনালকে (বিএন) তার প্রতিদ্বন্দ্বী পাকাতান হারাপান (পিএইচ) পেছনে ফেলেছে।
মারদেকা অর্গানাইজেশনের পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা পাকাতান হারাপানকে (পিএইচ) এবং ২৪ শতাংশ বারিসান ন্যাশনালকে (বিএন) পছন্দ করেছেন। তারপরে রয়েছে বারাসাতু ও পাসের সমন্বয়ে গঠিত পেরিকাটান ন্যাশনালের (পিএন) স্থান। যার প্রতি সমর্থন রয়েছে ১৩ শতাংশের। তবে এখানে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো- যারা তাদের পছন্দের কথা জানাননি তাদের সংখ্যা ৩১ শতাংশ। আর ৪ শতাংশ কোনো ধরনের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে চূড়ান্তভাবে এ ৩৫ শতাংশের মতো ভোটার পুরো ভোটকে প্রভাবিত করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। এর বাইরে দুই শতাংশ বলেছেন, তারা ডা. মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন গেরাকান তানাহ এয়ার (জিটিএ) বা অন্য কোনো দলকে ভোট দেবেন।
এ ছাড়া জাতিগতভাবে ভোট দেওয়ার পছন্দ হিসেবে মালয় ভোটারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৩২ শতাংশ বিএনকে পছন্দ করেছেন, তারপরে ২৯ শতাংশ বলেছেন- তাদের কোনো পছন্দ নেই বা তারা এখনো সিদ্ধান্ত নেননি। ২০ শতাংশ মালয় পিএনকে বেছে নিয়েছেন পছন্দের দল হিসেবে, হারাপান মালয়দের মধ্যে ১৩ শতাংশের সমর্থন পেয়েছে। জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৯ শতাংশ অনিশ্চিত মালয় ভোট নির্বাচনে যেকোনো উপায়ে প্রভাবশালী থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্থানীয় চীনা উত্তরদাতাদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ বলেছেন, তারা হারাপানকে পছন্দ করছেন, ৫ শতাংশ বিএনকে বেছে নিয়েছেন এবং ১ শতাংশ পিএনকে ভোট দেবেন। চীনাদের মধ্যে প্রায় ২৩ শতাংশ জানান, তাদের কোনো পছন্দ নেই বা এখনো পছন্দ ঠিক করেননি। ভারতীয়দের মধ্যে সমীক্ষায় ৫১ শতাংশ হারাপানকে পছন্দ করেছেন, বিএনকে পছন্দ করছেন ৩২ শতাংশ এবং পিএনকে এক শতাংশ ভোট দেবে বলে জানিয়েছেন। আট শতাংশ স্থানীয় ভারতীয় জানিয়েছেন, তাদের কোনো পছন্দ নেই বা এখনো কাকে ভোট দেবে ঠিক করেননি।
ভোটার উপস্থিতি প্রসঙ্গে জরিপে বলা হয়েছে, ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সীরা নির্বাচনে ভোট দিতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন।
পূর্ববর্তী ৩০ জুলাইয়ের সমীক্ষায় ৭৮ শতাংশ এবং ৩০ সেপ্টেম্বরের সমীক্ষায় ৮২ শতাংশ বয়সী ভোটার বলেছিলেন যে তারা ভোট দিতে আসবেন। তবে সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর সংখ্যাটি কিছুটা কমে ৮০ শতাংশে নেমে আসে। আগের দুটি জরিপে ৩১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ভোটারদের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৭৯ শতাংশ এবং ৭৮ শতাংশ ভোট দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর আগ্রহ কমে ৭৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
৩০’র কম বয়সীদের মধ্যে ভোট দেওয়ার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি কমেছে। আগের দুই সমীক্ষায় ৭৬ শতাংশ এবং ৭৪ জন উত্তরদাতা জানিয়েছেন তারা ভোট দেবেন। সর্বশেষ জরিপে সংখ্যাটি ৬৮ শতাংশে নেমে এসেছে। চীনাদের মধ্যে ভোটের প্রবণতা সব বয়সের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং মালয় ও ভারতীয়দের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ে (৭৫-৮৬ শতাংশ) ছিল।
আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফলের বিষয়ে মন্তব্য করে মারদেকা অর্গানাইজেশন জানিয়েছে, তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জোটের উপস্থিতি রয়েছে এবার। আর সেই সঙ্গে সম্ভাব্য ভোটের হারের বিষয়ে অনিশ্চয়তার কারণে চূড়ান্ত ফলাফল কী হবে তা এই মুহূর্তে অনুমান করা কঠিন।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে বিএন-্এর জন্য মালয় ভোটারদের সমর্থন প্রত্যাশিত স্তরের চেয়ে কম হওয়ায় এটা ধারণা করা যায় যে, কোনো জোটই এককভাবে মালয়েশিয়ায় ক্ষমতায় আসতে পারবে না। অন্য এক বা একাধিক দল বা জোটের সঙ্গে সরকার গঠনে কোয়ালিশন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আনোয়ার ইব্রহিমের পার্টি ও জোট এগিয়ে।
মালয়েশিয়ার দুটি অংশের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের মতো আসন হলো মালয়েশিয়ায়। বাকিটা সাবাহ ও সারওয়াক নিয়ে গঠিত বোর্নেও মালয়েশিয়ায়। দেশটির দুই অংশের রাজনীতির ধারার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বোর্নেও মালয়েশিয়ায় দেশটির মূল অংশের বড় দলগুলোর প্রভাব একবারে কম। কয়েক দশক ধরে সারওয়াকে সরকার গঠন করে আসছে স্থানীয় দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত একটি জোট। সাবাহতে একসময় আমনুর শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও সেখানে এখন শক্ত অবস্থানে চলে এসেছে স্থানীয় দলগুলো। বোর্নেও মালয়েশিয়ায় যে এক-তৃতীয়াংশের মতো আসন রয়েছে তাতে যারা প্রাধান্য বিস্তার করবে তারা ফেডারেল সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
গতবারের পাকাতান হারাপানের বিলুপ্ত সংসদে ১০৪ সদস্যের সমর্থন ছিল। সারওয়াকের জিপিএসের সমর্থন পেলে এ জোটের পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব হতে পারত। জোটের নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের সামনে বোর্নেও মালয়েশিয়ার দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে জোট গঠনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এরইমধ্যে আনোয়ার সেখান থেকে একজন উপপ্রধানমন্ত্রী করার কথাও ঘোষণা দিয়েছেন।
অন্যদিকে, একটি পক্ষ বারিসান ন্যাশনাল ও পেরিকাতান ন্যাশনালের সঙ্গে নির্বাচনের আগেই সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন। সেটি ড. আহমদ জাহিদ হামিদের সঙ্গে মহিউদ্দিন ইয়াসিনের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেননি। আবার নির্বাচনের পর ফলাফল স্পষ্ট হয়ে গেলে এ দুই জোটের মধ্যে আবারও কোয়ালিশন গঠনের চেষ্টা থাকবে।