নারী-পুরুষের নামাজের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কারণ-নারীর শারীরিক গঠন, সক্ষমতা, নিরাপত্তা ইত্যাদী নানা বিষয় পুরুষ থেকে ভিন্ন। তাই ইসলামী শরীয়ত স্বভাবসিদ্ধ এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বহু বিধানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে ভিন্নতা প্রদান করেছে।
ইহরাম অবস্থায় পুরুষের জন্য মাথা ঢাকা নিষেধ। অথচ মহিলাদের জন্য ইহরাম অবস্থায় মাথা ঢেকে রাখা ফরজ। ইহরাম খোলার সময় পুরুষ মাথা মুন্ডায়; কিন্তু মহিলাদের মাথা মুন্ডানো নিষেধ। পুরুষের ওপর জুমা পড়া ফরজ, নারীদের ওপর নয়।
ইমাম ও খতিব শুধু পুরুষই হতে পারে, কোন নারী হতে পারেনা। আজান শুধু পুরুষই দিবে, কোন নারীকে মুয়াজ্জিন বানানো জায়েজ নয়। পুরুষের সতর হলো নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত। আর পরপুরুষের সামনে নারীদের প্রায় পুরো শারীরই ঢেকে রাখা ফরজ ইত্যাদি।
ঠিক তেমনিভাবে নামাজ আদায়ের নিয়মের ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষের মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিধানগত ভিন্নতা রয়েছে যেমন তাকবীরে তাহরীমার জন্য হাত উঠানো, হাত বাঁধা, রুকু, সেজদা, প্রথম ও শেষ বৈঠক ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে পুরুষের সাথে নারীর পার্থক্য রয়েছে।
তাদের সতরের পরিমাণ যেহেতু বেশি তাই যেভাবে তাদের সতর বেশি রক্ষা হয় সেদিকটিও বিবেচনা করা হয়েছে ক্ষেত্রগুলোতে। মুসলিম উম্মাহর প্রায় দেড় হাজার বছরের অবিচ্ছন্ন আমলের ধারা তাই প্রমাণ করে। এই বিষয়ে চার মাযহাবের ইমামগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
নিম্নে এ সংক্রান্ত কিছু হাদিস, সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনের ফতোয়া উল্লেখ করা হলো-
১.তাবেয়ী ইয়াযীদ বিন আবী হাবীব রহ. বলেন- একবার রাসূল সা. দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদের (সংশোধনের উদ্দেশ্য) বললেন- ‘যখন সেজদা করবে তখন শরীর যমীনের সাথে মিলিয়ে দিবে। কেননা মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মত নয়। (সুনানুল বায়হাকী, হাদিস নং-৩০১৬, কিতাবুল মারাসিল লি ইমাম আবু দাউদ-৫৫, হাদিস নং-৮০)
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আলেম নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ “আওনুল বারী” (১/৫২০) তে লিখেছেন-“উল্লেখিত হাদিসটি সব ইমামদের উসুল অনুযায়ী দলীল হিসেবে পেশ করায় যোগ্য।’
মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আমীর ইয়ামানী “সুবুলুস সালাম” শরহু বুলুগিল মারাম” গ্রন্থে (১/৩৫১-৩৫২) এই হাদিসকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে পুরুষ ও মহিলার সেজদার পার্থক্য করেছেন।
২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সা. ইরশাদ করেছন-“মহিলা যখন নামাযের মধ্যে বসবে তখন যেন (ডান) উরু অপর উরুর উপর রাখে। আর যখন সেজদা করবে তখন যেন পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। যা তার সতরের জন্য অধিক উপযোগী। আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখে বলেন-ওহে আমার ফেরেস্তারা! তোমরা সাক্ষী থাক। আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। (সুনানে বায়হাকী-২/২২৩, হাদিস নং-৩৩২৪)
৩. হযরত ওয়াইল বিন হুজর রা. বলেন। আমি নবীজী সা. এর দরবারে হাজির হলাম। তখন তিনি আমাকে (অনেক কথার সাথে একথাও) বলেছিলেন যে, হে ওয়াইল বিন হুজর! যখন তুমি নামায শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে। আর মহিলা হাত উঠাবে বুক বরাবর। (আল মুজামুল কাবীর, হাদিস নং-২৮
সাহাবায়ে কিরামের ফতোয়া
১. হযরত আলী রা. বলেছেন-মহিলা যখন সেজদা করে তখন সে যেন খুব জড়সড় হয়ে সেজদা করে এবং উভয় উরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক-৩/১৩৮, হাদিস নং-৫০৭২, মুসান্নাফে ইবনে শাইবা-২/৩০৮, হাদিস নং-২৭৯৩, সুনানে কুবরা বায়হাকী-২/২২২)
২. হযরত ইবনে আব্বাসকে (রা.) জিজ্ঞেস করা হলো- মহিলারা কিভাবে নামাজ আদায় করবে? তিনি বললেন- “খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামাজ আদায় করবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৭৯৪)
তাবেঈনের ফাতওয়া
১. হযরত আতা বিন আবী রাবাহকে জিজ্ঞেস করা হলো- “নামাজে মহিলা কতটুকু হাত উঠাবে?” তিনি বললেন-“বুক বরাবর”। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা,-১/২৭০, হাদিস নং-২৪৮৬)
আরও দেখুন- মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৮৯৬, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/২৭০, হাদীস নং-২৪৮৭) মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক-৩/১৩৭, হাদিস নং-৫০৬৮, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০৩, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৭৯৫) (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক-৩/১৩৭, হাদিস নং-৫০৭১) (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০৩, হাদিস নং-২৭৯৯)
ইমাম আবু হানীফার (রহ.) অন্যতম শাগরেদ ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) বলেন- “আমাদের নিকট পছন্দনীয় হলো, নারীরা নামাজে উভয় পা একপাশে মিলিয়ে রাখবে। পুরুষের মত এক পা দাঁড় করিয়ে রাখবে না। (কিতাবুল আসার, ইমাম মুহাম্মদ রহ.-১/৬০৯)
আরো দেখুন, বাদায়িউস সানায়ে-১/৪৬৬-হেদায়া-১/১০০-১১০ আল মাবসূত লিস সারাখসী-১/৪৬৬,ফাতওয়ায়ে শামী-১/৫০৪, ফাতওয়ায়ে আলমগীরী-১/৭৩-৭৫, কিতাবুল উম্ম-১/১৩৮,{আয যাখীরা-২/১৯৩} {আল মুগনী-২/১৩৯}
দ্বিতীয় অংশ
উক্ত হাদিসটিতে সম্বোধন পুরুষদের করা হয়েছে, নারীদের নয়। হাদিসের পূর্ণ বিবরণ থেকে তা স্পষ্ট বুঝা যায়। ইমাম বুখারী রাহ. নিজ সনদে পূর্ণ হাদিসটি উল্লেখ করেন-
আবু সুলাইমান মালিক ইবনু হুওয়ায়রিস হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- আমরা কয়জন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে আসলাম। তখন আমরা ছিলাম প্রায় সমবয়সী যুবক। বিশ দিন তার কাছে আমরা থাকলাম। তিনি বুঝতে পারলেন, আমরা আমাদের পরিবারের নিকট প্রত্যাবর্তন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছি। যাদের আমরা বাড়িতে রেখে এসেছি তাদের ব্যাপারে তিনি আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন। আমরা তা তাকে জানালাম। তিনি ছিলেন কোমল হৃদয় ও দয়ার্দ্র। তাই তিনি বললেন- তোমরা তোমাদের পরিজনের কাছে ফিরে যাও।
তাদের (কুরআন) শিক্ষা দাও, সৎ কাজের আদেশ কর এবং যে ভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছ ঠিক তেমনভাবে সালাত আদায় কর। সালাতের ওয়াক্ত হলে, তোমাদের একজন আজান দেবে এবং যে তোমাদের মধ্যে বড় সে ইমামত করবে। (বুখারি, হাদিস নং-৬০০৮)
এ হাদিসে খেয়াল করুন-
* কতিপয় যুবক সাহাবী এসেছেন। তাদের সবাই যুবক। তাদের মাঝে কোন নারী ছিল না।
* বাড়িতে গিয়ে স্বীয় এলাকাবাসীকে কুরআন শিক্ষা সৎ কাজের আদেশের নির্দেশনা দিলেন। এরপর তোমরা বলে পরপর তিনটি নির্দেশনা দিলেন।
যথা-
১. আমাকে যেভাবে দেখেছো সেভাবে তোমরা নামাজ পড়বে।
২. নামাজের সময় হলে তোমাদের মধ্য হতে একজন আযান দিবে।
৩.নামাজের জন্য তোমাদের থেকে যে বড় সে ইমাম হবে।
পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ-
হাদিসে উল্লেখই আছে, যারা রাসূল (সা.)-এর সামনে ছিলেন। তারা পুরুষ। সম্বোধন তাদেরই ছিল।
তাছাড়া হাদিসটির শেষদিকে নবীজী (সা.) আজান ও ইমামতির নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশটি আরও স্পষ্ট করে, এখানে নারী-পুরুষ উভয়কেই সম্বোধন করার দাবি সঠিক নয়।
উত্তর দিয়েছেন- মুফতি সাদেকুর রহমান, মুফতি ও মুহাদ্দিস, শেখ জনূরুদ্দীন (র.) দারুল কুরআন মাদ্রাসা, চৌধুরীপাড়া, ঢাকা।