ইসলামী বর্ষপঞ্জির সূচনা হয় এক গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস দিয়ে। যার নাম মহরম মাস। মাস শুধু হিজরি বছরের প্রথম মাস নয়, বরং এটি ইতিহাস, আত্মত্যাগ ও সত্য প্রতিষ্ঠার প্রতীকও বটে৷ কারবালার ঘটনা এই মাসকে করে তুলেছে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও আবেগঘন। চলুন, মহরম সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানি। বোঝার চেষ্টা করি ইতিহাস, ফজিলত, আশুরা এবং ইমাম হুসাইনের (রা.) আত্মত্যাগ থেকে কী শিক্ষা পাওয়া যায়। সাথে থাকছে মহরম কত তারিখে ২০২৫ সালে এ ব্যাপারেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
মহরম শব্দের অর্থ নিষিদ্ধ বা সম্মানিত। ইসলাম পূর্ব যুগেও এই মাসকে সম্মানের মাস হিসেবে গণ্য করা হতো। হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস হিসেবে মহরমকে আল্লাহ তা’আলা পবিত্রতা দিয়েছেন। কুরআনে বলা হয়েছে:
“আল্লাহর কাছে মাস বারোটি, যেদিন তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি পবিত্র।” (সূরা আত-তাওবা: ৩৬)
মহরমের গুরুত্ব শুধু হিজরি বর্ষপঞ্জির শুরুর কারণে নয়! বরং বহু ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে এই মাস মর্যাদাপূর্ণ। এ মাসে বহু নবীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয় বলে হাদীসে উল্লেখ আছে।
কিন্তু সর্বাধিক আলোচিত ঐতিহাসিক ঘটনা হলো ৬১ হিজরি সালের কারবালার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা.) এবং তাঁর পরিবার সত্য ও ন্যায়ের পথে জীবন উৎসর্গ করেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রমজানের পর সবচেয়ে ফজিলতের রোজা হলো মহরম মাসে। (সহীহ মুসলিম)। সুতরাং এই মাসে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য রোজা, দোয়া, ইবাদত ও আত্মসমালোচনার গুরুত্ব অপরিসীম।
১০ই মহরম, যাকে আমরা আশুরা বলি, ইসলামী ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। ঐদিন ৩ টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। যেমন:
এই কারণে রাসূল (সা.) ১০ই মহরমে রোজা রাখতেন এবং ৯ কিংবা ১১ তারিখেও রোজা রাখতে উৎসাহ দিতেন।
আশুরা শব্দটি এসেছে আশারা অর্থাৎ সংখ্যা দশ থেকে। এটি হিজরি বছরের প্রথম মাসের দশম দিন। যা আবার ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের জন্যও বিশেষ দিন ছিল। রাসূল (সা.) তাদের থেকে আলাদা থাকতে চাইতেন বলে ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখে রোজা রাখতে বলেছেন।
৬১ হিজরির ১০ মহরম কারবালায় সংঘটিত হয় এক মানবতার ইতিহাস। ইয়াজিদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সত্য ও ইসলামের মূলনীতি রক্ষায় ইমাম হুসাইন (রা.) এবং তাঁর পরিবার নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। আর তাঁর এই আত্মত্যাগ আমাদের শিক্ষা দেয়, অন্যায়ের সঙ্গে আপস নয় এবং সত্যের জন্য জীবন দেওয়া সবসময়ই গৌরবের!
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মহরম মাসকে কেন্দ্র করে শোক পালন করা হয়। তবে ইসলামে শোক পালন মানে আত্মশুদ্ধি, শিক্ষা গ্রহণ ও সত্যের পথে চলা। অতি আবেগ বা শরিয়া-বহির্ভূত রীতির প্রতি সাবধান থাকতে হয়।
মহরম মাসে রোজার অনেক ফজিলত রয়েছে। বিশেষ করে আশুরার রোজা রাখতে পারলে অনেক সওয়াব পাবেন। তাছাড়া এই রোজায় পূর্ব বছরের গোনাহ মাফ করা হয়। সেই সাথে নফল রোজা হিসেবে এই বিশেষ রোজা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ হিসাবে কাজ করে৷
একজন মুসলিম আমাদের মহরম পালনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত এর সঠিক ইতিহাস জানা, কারবালার শিক্ষাগুলো জীবনচর্চায় প্রয়োগ করার চেষ্টা করা, এই সময় বাড়তি ইবাদতে মনোযোগ দেওয়া এবং সবশেষে যতটা সম্ভব বিদআত থেকে দূরে থাকা।
মহরম মাসে যা ঘটেছে, তা আমাদের অনেক শিক্ষা দেয়। এর মাধ্যমে আমরা ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য করতে শিখি, ত্যাগ ও আত্মসমর্পণের মানেটা বুঝি, ব্যক্তিজীবনে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধি করতে পারি৷
২০২৫ সালে হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী মহরম মাস শুরু হবে ২৮ জুন, শনিবারে। অর্থাৎ, ১ মহরম ১৪৭৭ হিজরি হবে ২৮ জুন ২০২৫ তারিখে। তবে ইসলামী মাস চাঁদের উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়, তাই বিভিন্ন দেশে এক-দু’দিন পার্থক্য থাকতে পারে। মোটকথা সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৫ সালে ১০ মহরম (আশুরা) পড়বে ৭ জুলাই, সোমবার।
মনে রাখবেন, মহরম একটি পবিত্র ও শিক্ষনীয় মাস। যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সত্যের জন্য সংগ্রাম, ত্যাগের মহিমা এবং ন্যায়ের পথে জীবন উৎসর্গের শিক্ষা জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আসুন আমরা এই মাসকে আত্মশুদ্ধির মাস হিসেবে গ্রহণ করি এবং শরিয়া অনুযায়ী পালন করি।