সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া নাগরিকদের জমা দেওয়া চাঁদার বিপরীতে ৮ শতাংশ হারে সুদ দেবে সরকার। তবে বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা পরিশোধ করে প্রবাসীরা অতিরিক্ত ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা পাবেন। নির্ধারিত সুদহারের বাইরে রেমিট্যান্সের মতো প্রণোদনার সুবিধা থাকায় এই পেনশন স্কিম প্রবাসীদের জন্য নিরাপদ সঞ্চয় ও ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা আশা প্রকাশ করে বলছেন, ভবিষ্যতের আর্থিক নিরাপত্তার কারণে প্রবাসীদের পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে উৎসাহিত করবে। এ ছাড়া সংকটকালে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াবে।
সরকারি চাকরি ও পেনশন ব্যবস্থায় যারা অন্তর্ভুক্ত নন, প্রাথমিকভাবে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় এমন চারটি শ্রেণিকে যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রবাসীরা অন্যতম।
সর্বজনীন পেনশন নিয়ে আপনার প্রশ্নের উত্তর জেনে নিন
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই বিদেশ থেকে দেশে থাকা ভাই, বোন, এমনকি বাবার কাছে টাকা পাঠিয়েও প্রতারিত হচ্ছেন। দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে এসে নিজেদের নিঃস্ব অবস্থায় দেখতে হচ্ছে প্রতারণার শিকার এসব ব্যক্তিকে। সর্বজনীন পেনশনে অংশগ্রহণ করলে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না তাদের। তাই পেনশন স্কিমে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হবে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তারা নিজেরা যেমন উপকৃত হবে, একইভাবে দেশে বিদেশি মুদ্রার সংকট কাটাতেও ভূমিকা রাখতে পারবেন।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বাঙ্গাখাঁ ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুল মালেকের কথাই ধরা যাক। ১৯৯৪ সালে স্থানীয় একটি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস করে তিনি পাড়ি জমান সৌদি আরব। বাবা বরকত উল্লাহ ১৯৯৫ সালে মারা যাওয়ায় পরিবারের হাল ধরতেই দেশে চাকরির চেষ্টা না করেই মালেক বিদেশে পাড়ি জমান। বড় ভাই আবদুল খালেক বাড়ির পাশেই একটি চায়ের দোকান চালান। বাড়িতে একমাত্র পুরুষ হিসেবে বড় ভাইয়ের কাছেই আয়ের অর্থেও সবটাই পাঠাতেন মালেক। ২০১০ সালে স্থানীয় বাজারে একটি দোকান বিক্রি হওয়ার খবর দেন বড় ভাই খালেক। তার পরামর্শে ২০ লাখ টাকায় ওই দোকান কেনার সিদ্ধান্ত নেন মালেক। দায়িত্ব দেন বড় ভাইকে। দোকান কেনা হয়।
আবদুল মালেক ২০১৩ সালে বাড়ি ফিরে বিয়ে করেন। ছয় মাস পর আবার পাড়ি জমান সৌদি আরব। যথারীতি বাড়ির সব দায়িত্ব বড় ভাই পালন করেন। এরপর ২০১৫ সালে তিন লাখ টাকা দিয়ে বাড়ির পাশে একখ- জমি কেনেন। ২০২০ সালে সৌদিতে মালিকের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় বাড়ি ফিরতে হয় মালেককে। প্রথম ছয় মাস সুন্দরভাবে চলছিল তার। কিন্তু দিন যত যাচ্ছিল ততই বড় ভাইয়ের আচরণে পরিবর্তন দেখতে পান। ছয় মাস পর বাজারে নিজের টাকায় কেনা দোকানে নিজেই ব্যবসার সিদ্ধান্ত নেন। আর তখনই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বাধা হয়ে দাঁড়ান বড় ভাই আবদুল খালেক। দাবি করেন, ওই দোকান মালেকের নয়। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে সালিশ বসে। তখনই প্রকৃত ঘটনা জানতে পারেন মালেক। অর্থাৎ বিদেশে থেকে যে টাকা পাঠিয়েছেন এবং ওই টাকায় যেসব জমি কেনা হয়েছে সবই তার ভাইয়ের নামে। নিমিষেই নিঃস্ব হয়ে গেলেন ২৫ বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে আসা মালেক।
শুধু লক্ষ্মীপুরের আবদুল মালেকই নন, প্রবাসে থেকে এমন প্রতারিত হওয়ার তালিকা অনেক লম্বা। এই প্রতিবেদক এমন অন্তত ১০ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন, যারা প্রবাসে থাকা অবস্থায় বিশ্বাস করে স্ত্রী, ভাই, বোন, বাবা বা স্বজনদের কাছে টাকা পাঠিয়ে প্রতারিত হয়েছেন।
লক্ষ্মীপুরের আবদুল মালেক বর্তমানে স্থানীয়ভাবে সুপারির ব্যবসা করেন। অল্প পুঁজির কারণে কোনো রকম সংসার চালাচ্ছেন তিনি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বড় ভাইকে বিশ্বাস করে বিদেশে আয় করে পুরো টাকাই পাঠিয়েছি দেশে। কিন্তু তিনি প্রতারণা করায় আজ আমি ফকির। এখন আল্লাহর কাছে বিচার দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।’
চাঁদপুরের জামাল হোসেন প্রতারিত হয়েছে স্ত্রীর কাছে। তিনি বলছিলেন, ‘১৫ বছর বিদেশ করেছি। পুরো টাকাই স্ত্রীকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু দেশে ফিরে আসার সপ্তাহখানেকের মাথায় স্ত্রী অন্য একজনের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। দেশে ফিরে স্ত্রীও হারালাম, অর্থকড়ি সবই।’
বাবার প্রতারণার শিকার হয়েছেন নীলফামারীর মঈন হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখনো বিদেশে থাকি। গত বছরের ডিসেম্বরে বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি বাবার কাছে জমি কেনার জন্য যে টাকা পাঠিয়েছি সব জমিই তিনি নিজের নামে নিয়েছেন। বাবা মারা যাওয়ায় এখন ৮ ভাই ও দুই বোন সবাই আমার টাকায় কেনা জমির মালিক।’ তবে এতে হতাশ নন এই প্রবাসী। বললেন, ‘অনেকের মতো বাড়ি ফিরে আমি তো নিঃস্ব হইনি। প্রবাসে থেকে এখনো আয় করছি।’
সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হলে বিদেশে থেকে ফিরে অন্তত নিজেদের এমন নিঃস্ব অবস্থায় দেখতে হবে না প্রবাসীদের।
জানা গেছে, সর্বজনীন পেনশনের আওতায় প্রবাসীদের জন্য ‘প্রবাস’ স্কিম থাকছে। এই স্কিমের অধীনে মাসিক চাঁদার সর্বনিম্ন হার ৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সাড়ে সাত হাজার ও সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা হারে চাঁদা দেওয়া যাবে। প্রবাস স্কিমের চাঁদা বিদেশি মুদ্রায় দিতে হবে।
প্রবাসী কেউ যদি ১৮ বছর বয়সে পেনশন হিসেবে সর্বনিম্ন হার ৫ হাজার টাকা করে মাসিক চাঁদা দিতে শুরু করেন এবং ৬০ বছর পর্যন্ত নিয়মিত চাঁদা জমা দেন, তাহলে অবসরের পর অর্থাৎ ন্যূনতম ৭৫ বছর পর্যন্ত প্রতি মাসে এক লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা হারে পেনশন পাবেন। ৪২ বছর মাসিক এই হারে চাঁদা দিলে তার জমা হবে ২৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। আর তিনি ন্যূনতম ১৫ বছরে পেনশন পাবেন ৩ কোটি ১০ লাখ ১৮ হাজার ৮৬০ টাকা।
পেনশনধারী ৭৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই মারা গেলে, তার নমিনি অবশিষ্ট মেয়াদে মাসিক একই হারে পেনশন পাবেন। এ ছাড়া ন্যূনতম ১০ বছর ধরে চাঁদা দেওয়ার শর্ত পূরণের আগেই কেউ মারা গেলে, মুনাফাসহ তার নমিনিকে জমা অর্থ ফেরত দেওয়া হবে।
বিদ্যমান আইনের আওতায় ১৮ বছর বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সী সব প্রবাসী সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় যুক্ত হতে পারবেন। ৬০ বছর বয়স থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন।
তবে ৫০ বছরের বেশি বয়সীরাও সর্বজনীন পেনশন সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। তবে অন্যদের মতো ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশন সুবিধা পাবেন না তারা। ১০ বছর চাঁদা পরিশোধের পর তারা আজীবন পেনশন পাওয়া শুরু করবেন। অর্থাৎ, কেউ ৬০ বছর বয়সে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হলে তিনি ১০ বছর চাঁদা পরিশোধের পর ৭০ বছর বয়স থেকে পেনশন সুবিধা পাবেন।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা অনুসারে, নাগরিকরা যেকোনো সময় সর্বজনীন পেনশনের এক স্কিম থেকে অন্য স্কিম কিংবা চাঁদার পরিমাণ একটা থেকে অন্যটা গ্রহণ করতে পারবেন।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাসার দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রবাসীদের অনেকের চাকরি এবং আয়ের ক্ষেত্রে ভারসাম্য থাকে না। এ ক্ষেত্রে তারা ওই পেনশন স্কিমের কিস্তি সচল রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এমন পরিস্থিতিতে কী হবে তা এখনো উল্লেখ করা হয়নি। পেনশন স্কিম চালু হলে বলা যাবে তা কতটুকু কার্যকর করা যাচ্ছে। তবে যদি কার্যকর করা যায় তাহলে সাধারণ প্রবাসীরা উপকৃত হবেন।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই স্কিম কতটুকু কাজ করবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ বেশিরভাগ প্রবাসী চুক্তিভিত্তিক ভিসায় দুই-তিন বছরের জন্য বিদেশে যায়। সে ক্ষেত্রে তারা তিন বছর পর ফিরে এলে এ স্কিমের অর্থ পরিশোধ করবে কীভাবে? তার ব্যাখ্যা নেই। তাই যারা এ ধরনের ভিসা নিয়ে বিদেশ যাবে তারা পেনশন স্কিমে যুক্ত হবে না। এ জন্য নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকার দরকার ছিল।