বিমানবন্দরে হাসিমুখে বিদায়… আর হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা হাজারো অশ্রু! এটাই প্রবাস জীবনের শুরুর দিককার গল্প। আজ আমি প্রবাসীদের নিয়ে কিছু কষ্টের কথা শেয়ার করবো। যা আমরা কখনোই বুঝতে পারি না বা বোঝার চেষ্টা করি না।
প্রবাস জীবনের বাস্তবতার সাথে জড়িয়ে থাকে অসংখ্য ত্যাগ, কষ্ট, আর একাকীত্বের গল্প। আমরা যারা দেশে থাকি, প্রায়ই ভুলে যাই ডলার বা রিয়ালের পেছনে লুকিয়ে থাকে কত রাতের নির্ঘুম পরিশ্রম, কতটা মানসিক চাপ, আর কতবার চোখের পানি চেপে রাখার গল্প!
প্রবাসীদের নিয়ে কিছু কষ্টের কথা বলার শুরুতেই বলবো প্রবাসীদের ঘরের মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকার বিষয়টি। একজন প্রবাসী বাবা বছরের পর বছর সন্তানের স্কুলে যাওয়া দেখা পান না, মা’র অসুস্থতার সময় পাশে থাকতে পারেন না। ফোনের স্ক্রিনই হয়ে যায় তাদের একমাত্র সান্ত্বনা।
প্রতিদিন একই রুটিন! আবার সাথে নেই কোনো ছুটি। খেয়াল করলে দেখবেন বেশিরভাগ প্রবাসী এমন কাজে যুক্ত থাকেন যেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খাটতে হয়। আবার প্রায়ই সপ্তাহে সাত দিনই তাকে কাজ করতে হয়। দিনশেষে প্রচুর কাজের চাপের কারণে শরীর-মন দুইই ক্লান্ত হয়ে যায়।
প্রতিটি প্রবাসীরই দেশে থাকতে মন চায়। কিন্তু পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য বিদেশে থাকা বাধ্যতামূলক। এই দ্বন্দ্বটা প্রবাসীদের প্রতিদিন পোড়ায়।
নিজের ভাষা, খাবার, উৎসব সবই যেনো ফিঁকে হয়ে যায় বিদেশে। ঈদের নামাজ শেষ হয়, কিন্তু বাড়ি ফিরে সেই গরম খিচুড়ি বা মা’র হাতের সেমাই আর মেলে না।
প্রবাস জীবনের বাস্তবতার আরো একটি কঠিন পয়েন্ট হলো ঈদের দিনেও ফাঁকা রুম। সবাই ঈদের নামাজ শেষে গরুর মাংস কেটে রান্না করছে, ঘরে হাসি-আনন্দের মেলা। কিন্তু নিজে? নিজে ছোট্ট চুলা জ্বালিয়ে নুডলস রান্না করছে। আর ফোনে ভিডিও কলে পরিবারের হাসি দেখে তৃপ্ত হচ্ছে।
এমনও অনেক প্রবাসী আছেন যারা কিনা মা’র শেষ সময়ে ফিরতে পারেন না। টিকিট কাটার আগেই কলে জানতে পারেন মায়ের মৃত্যু হয়েছে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এমনও হয়, মাস শেষে টাকা পাঠালেন, কিন্তু সেই টাকা মায়ের হাতে পৌঁছাল না।
কখনো শুনেছেন, শীতের রাতে শরীরে ঘাম হয়? হ্যাঁ হয়! এ যেনো প্রবাস জীবনের বাস্তবতার কঠিনতম পয়েন্ট। একদিন একটি ভিডিও দেখছিলাম! যেখানে দেখেছি মধ্যপ্রাচ্যের এক প্রবাসী রাত ২টা পর্যন্ত রাস্তার কাজ করছিলেন। তীব্র ঠান্ডায় কংক্রিট মেশাচ্ছেন। ঠান্ডায় হাত-পা অবশ, কিন্তু কাজ থামানোর সুযোগ নেই। ওদিকে সেদিনই ছিলো তার মেয়ের জন্মদিন।
প্রবাসীদের নিয়ে কিছু কষ্টের কথা বলবো অথচ তাদের বেতন পেলেও নিজের জন্য কিছু না কেনার বিষয়টি বলবো না তা কি হয়? প্রবাসীরা মাস শেষে বেতন পায়। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে নিজের জন্য নতুন জুতা বা পোশাক কেনা হয় না। শুরুতেই সেই বেতন পাঠিয়ে দেয় পরিবারের কাছে। যা দিয়ে বাবার ঔষধ, ভাইয়ের পড়াশোনা, বাড়ির ভাড়া, বোনের বিয়ের খরচ সবকিছু ম্যানেজ করতে হয়।
অনেক প্রবাসী ৫-৭ বছর পর দেশে ফিরলে দেখেন পাড়া বদলে গেছে, বন্ধুদের জীবন এগিয়ে গেছে, এমনকি নিজের সন্তানও তাকে একটু অচেনা ভাবে। এটা এমন এক ব্যথা যা টাকার মানদন্ড দিয়ে মাপা যায় না।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি প্রবাসী পরিবারকে চালিয়ে নিচ্ছে। অথচ জানলে অবাক হবেন জরিপে দেখা গেছে, প্রবাসীদের ৭০% মানুষ একাকীত্বে ভোগেন। শুধু তাই নয়! আবার ৫০% এর বেশি প্রবাসী মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় আক্রান্ত।
কারণ প্রবাসীদের প্রতিটি হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে অসংখ্য রাতের অশ্রু, পরিবার থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণা, আর নিজের স্বপ্ন ত্যাগের কষ্ট। মনে রাখবেন তারা শুধু টাকা পাঠাচ্ছেন না, তারা পাঠাচ্ছেন ভালোবাসা, ত্যাগ, আর অসম্ভব ধৈর্যের গল্প। তাই তাদের প্রতি একটু সদয় হোন!