প্রবাস জীবন কতোটা কষ্টের এই গল্পে বুঝবেন

প্রবাস প্রতিদিন
আপডেটঃ : রবিবার, ২ জুলাই, ২০২৩

প্রবাস জীবন ‍যে কতোটা কষ্টের তা যখন আপনি কোন প্রবাসীর মুখে শুনবেন তখন বুঝবেন। প্রবাসীরা তাদের কষ্টগুলো অন্তরে পুষে রাখে। সহজে কাউকে বলতে পারে না। আজ আমরা এমন একজন প্রবাসীর কথাই শুনবো। তার কষ্টের কথাগুলোর সাথে সাথে অভিজ্ঞতার কথাগুলোও শুনবো।

পাঠকের বুঝার সুবিধার্থে প্রবাসী ভাই যেভাবে তার কথাগুলো বলেছেন সেভাবেই তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো। তাহলে চলুন শুরু করি।

আমি মোঃ আমিনুল ইসলাম। আমার বাড়ি পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলায়। আমি গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে পড়াশোনা শেষ করি। তারপর পাশের গ্রামের হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করি। ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করে দেশেই কোনো কিছু করার।

কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সেটি আর সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। আমি তখন কলেজে পড়ি। হঠাৎ আমার বাবা একদিন আমায় বলে যে, তোকে বিদেশে পাঠাবো।

আমি শুনেই অবাক। হঠাৎ আমাকে নিয়ে এই ভাবনা কোথ্যেকে এলো? কিন্তু আমি সব কিছু পজিটিভলী নিলাম। ভাবলাম, বিদেশ যাবো – খুব মজা হবে। অনেক কিছু দেখবো। মোট কথা বিদেশ দেখবো। কিন্তু দেখার অন্তরালে যে কতোটা কষ্ট তা আর জানতাম না।

যাই হোক, পরে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলাম। এরপর মোটামুটি সিদ্ধান্ত ফাইনাল করে ফেললাম যে, বিদেশেই যাবো। দেশও জানলাম। সেটা হলো সিঙ্গাপুর।

আমার বাবার তেমন কোনো অর্থ সম্পত্তি ছিলো না। কয়েক বিঘা জমি ছিল। সেগুলো বর্গা দেয়া হলো। মোটামুটি ৭ লক্ষ টাকার প্রয়োজন পড়লো। বাড়ি থেকে ৪ লক্ষ টাকার মতো জোগাড় করা হলো। আর বাকি টাকা ব্র্যাক নামক সমিতি থেকে ঋণ নেয়া হলো।

সব মিলে ৭ লক্ষ টাকাই যোগাড় করা হলো। আমি আমার পাসপোর্ট তৈরী করলাম। পাসপোর্ট তৈরী করতে গিয়ে আমি অনেক ভোগান্তির শিকার হয়েছি। কয়েক মাস লেগেছে আমার পাসপোর্ট হাতে পেতে।

এরপর ভিসা চলে এলো। সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমি উড়াল দিলাম সিঙ্গাপুরের পথে। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আমি সিঙ্গাপুর গিয়ে পৌছলাম। নির্ধারিত ব্যক্তি এসে আমাকে নিয়ে ‍গেলো।

কিন্তু যে পরিবেশে আমাকে নিয়ে গেল সেই পরিবেশটা আমার একদমই পছন্দ ছিলো না। কারণ, ছো্ট্ট একটা রুম যেখানে কয়েকজন মিলে থাকতে হয়। খাবার দাবার প্রথম প্রথম খেতে পারতাম না। কারণ, রান্না মোটেও ভালো ছিলো না।

খুব সকালে উঠেই কাজে যেতে হয়। কাজ হলো রাজ মিস্ত্রির কাজ। সেখানে যোগালী হিসেবে আমাকে কাজ করতে হবে। প্রথম প্রথম কাজ করতে খুব অসুবিধা হতো। সময় অপচয় করা যেত না। নির্ধারিত দিন ছাড়া কোনো ছুটি ছিলো না।

কাজের সময় কখনো দেশের কারও কাছে ফোন করে কথা বলতে পারতাম না। কারণ, সেটা খুবই নিষিদ্ধ ছিলো। আর যদি কখনো কেউ এরকম করতো তাহলে তাকে নানা ধরণের গালি গালাজ করা হতো।

যে কোম্পানীর আন্ডারে আমি কাজ করতাম সেই কোম্পানীর কাজ বেশ ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু বেশিদিন তা স্থায়ী হয়নি। মাত্র ১ বছর পরেই কোম্পানীর কাজ শেষ হয়ে যায়। এদিকে আমার ঋণ তখনো শোধ হয়নি। অনেক টাকা কিস্তি দিতে হতো প্রতি মাসে।

আমি সবসময়ই টেনশন করতাম। কিভাবে এই টাকা শোধ করবো? কতদিন লাগবে? যখন এসব চিন্তা মাথায় ভর করতো তখন খুব কান্না পেত। কাউকে পাশে পেতাম না। হয়তো ভিডিও কলে একটু কথা বলতে পারতাম বাসায় – সর্বোচ্চ এই টুকুই।

কোম্পানী তখন আমাকে আমার ভিসার মেয়াদ তথা কাজের মেয়াদ বাড়াতে বললো। আর এই জন্য দরকার আরো প্রায় দুই লক্ষ টাকা। মাথায় যেন আমার আকাস ভেঙে পড়লো।

কোনো ধরণের উপায় না পেয়ে বাসায় সব কিছু জানালাম। কারণ, আর কোনো অপশন ছিলো না। বাসায় জানার পরে তাদের মাথায়ও যেন আকাস ভেঙে পড়লো। তারা সবাই একথা শুনে কান্নাকাটি পর্যন্ত করেছিল।

কারণ, তখন যদি আমি দেশে ফিরে আসি তবে আমার বহু টাকা ক্ষতি হয়ে যায়। যে পরিমাণ টাকা আমি খরচ করে বিদেশে গিয়েছি সেই টাকার অর্ধেক পরিমাণও তখন আমি ইনকাম করিনি। সব মিলে আমি যদি তখন বাসায় ফিরে আসি তাহলে আমার পরিবার রাস্তায় নেমে যাবে। তাছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকতো না।

এরপর আবার ২ লক্ষ টাকা ধার দেনা করে যোগাড় করা হলো। আমার কাজের মেয়াদ বাড়ানো হলো। আমি আবার এক বুক স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করলাম। কোনো কষ্টকেই কষ্ট মনে করলাম না।

প্রতিদিন কাজের পর যখন রাতে বাসায় ফিরে আসি তখন শুধু আমার হাতে আমার মোবাইল ফোনটি থাকে। সেটির সাহায্যে বাসায় মা-বাবার সাথে একটু খানি কথা-বার্তা বলা ছাড়া আর কোনো কিছু করার থাকে না।

মন চাইলেও দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে পারি না। কারণ, কিছু বিধি-নিষেধ রয়েছে। অন্যদিকে, আরো যেসব ছোট-খাটো সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। সেগুলো যদিও কষ্ট কিন্তু কষ্ট মনে করলে কেউ প্রবাসে থাকতে পারবে না।

প্রবাসে যারা থাকে তাদের চোখের পানি দেখারও কেউ থাকে না। আবার চোখের পানি মুছে দেয়ারও কেউ থাকে না। সব মিলে একজন প্রবাসী শুধুই প্রবাসী – শুধুই একা। প্রবাস জীবন জঙ্গলে একা থাকার মতো।

যারা তাদের স্ত্রীকে দেশে রেখে যায় তারা তো আরো বেশি কষ্টের স্বীকার হয়। কারণ, না পারে স্ত্রীকে মনের সব কষ্ট বোঝাতে, আবার না পারে স্ত্রীর মনের কথা বুঝতে। কারণ, কোনো উপায় থাকে না। প্রবাস জীবন এক্ষেত্রে মানুষের অন্তরকে পুড়ে ছাই করে দেয়।

আমি এখন ভালোই আছি। তবে খুব ভালো নেই। কাজের প্রেসার প্রতিনিয়তই থাকে। মাঝে মধ্যে শরীর যদি খারাপ হয় তবে খুব কষ্ট হয়। একা একা সব কিছু করতে হয়। পাশে থাকার কেউ থাকে না। সবাই তো নিজ নিজ পরিবার আর নিজেকে নিজেই ব্যস্ত। কে রাখে কার খবর?

আমার বাবা যে পরিমাণ টাকা ঋণ করে আমাকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন সেই পরিমাণ টাকা আমি শোধ করেছি। এখন বর্তমানে খানিকটা সঞ্চয় করতে পারতেছি। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে কিছু টাকা পয়সা নিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখতে পারবো।

অনেকেই ভাবে যে, বিদেশ গেলেই বুঝি শুধু টাকা আর টাকা। কিন্তু বিষয়টি এরকম নয়। যারা বিদেশে এত টাকা খরচ করে আসে তাদের আসলে পরে মন চাইলেই ফিরে যাওয়ার কোনো অপশন থাকে না।

অনেক প্রবাসী এসব কারণ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে ফেলে। পত্র-পত্রিকায় এরকম ঘটনা অনেক প্রকাশ হয়েছে পূর্বে। তবে দেশের মাটিতে যাদের কিছু করে খাওয়ার মতো অপশন আছে আমি মনে করি তাদের দেশেই থাকা ভালো।

টাকা হলেই শান্তি হয় না ভাই। শান্তির জন্য দরকার পরিবার, স্ত্রী পরিজন এবং আত্মীয়-স্বজন। নিজের মনের মতো করে কিছু করাটা বিদেশে সম্ভব না। এটা কেবল দেশেই সম্ভব, প্রবাস জীবন এ কোনোভাবেই সম্ভব না।

আমি আর ২ বছর পরে দেশের মাটিতে পা রাখবো ইনশাআল্লাহ। অবশ্যই যদি বেঁচে থাকে। আমি বিদেশের মাটিতে পা রাখার পরে গ্রামের বেশ কয়েকজন মানুষ মারা গিয়েছে। তাদের কবরে আমি মাটি দিতে পারিনি। তাদের একবার শেষ দেখাটাও দেখতে পারিনি। হয়তো ভিডিও কলে দুই একজনকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।

এরকম বহু কষ্ট রয়েছে ভাই। সব কথা বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। আপনার পাশের বাড়ির কেউ যদি প্রবাসে থাকে তবে তার কাছে শুনে নিয়েন। তবে সবার কপালে সমান সব কিছু জুটে না। কেউ কেউ খুব ভালো কোম্পানীতে কাজ পায়। একটু ভালো থাকে।

আরও পড়ুন: প্রবাসীদের ঈদে নীরব কান্না

কিন্তু গড় হিসেবে প্রায় ৮০ ভাগ প্রবাসীই কোনো না কোনো দিক থেকে কষ্টে থাকে। কষ্টগুলো লুকিয়ে রাখে। সবাই শুধু প্রবাসে থাকা মানুষটির কাছে চেয়েই যায়। কিন্তু প্রবাসে থাকা মানুষটার কষ্টগুলোর ভাগিদার কেউ হতে পারে না।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ